Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য ছাতা, পান আর কালো ডায়রি: হারিয়ে যাওয়া সেই সনাতন ঘটকালি

ছাতা, পান আর কালো ডায়রি: হারিয়ে যাওয়া সেই সনাতন ঘটকালি

ফরিদুল আলম, ঢাকা: গ্রামের মেঠো পথ। চৈত্রের কড়া রোদ কিংবা শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টি। মাথার ওপর ছাতা ধরে, ধুতি কিংবা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন। বগলের নিচে সযত্নে রাখা একটি জীর্ণ কালো মলাটের ডায়রি। আর মুখে পানের পিক। দূর থেকে দেখেই গ্রামের মানুষ বুঝে নিত ‘ঘটক মশাই’ আসছেন। কারো ঘরে হয়তো বিয়ের সানাই বাজার অপেক্ষার প্রহর গুনছে।

বাঙালির চিরায়ত বিবাহ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই সনাতন ঘটকরা। প্রযুক্তির দাপট আর ম্যারেজ মিডিয়ার যুগে সেই ‘জীবন্ত সোশ্যাল মিডিয়া’ খ্যাত ঘটকদের এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। আমাদের তিন পর্বের বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

বগলের সেই কালো ডায়রি: এক ভান্ডার রহস্য
তখনকার দিনে স্মার্টফোন ছিল না, ছিল না হোয়াটসঅ্যাপ বা ই-মেইলে বায়োডাটা পাঠানোর সুযোগ। ঘটকের বগলের নিচে থাকা সেই কালো ডায়রিটিই ছিল তথ্যের খনি। তাতে হিজিবিজি হাতে লেখা থাকত—অমুক গ্রামের চৌধুরীদের মেজো ছেলে বিএ পাস, তমুক গ্রামের বড় বাড়ির ছোট মেয়ে দেখতে লক্ষ্মী প্রতিমা। ঘটক যখন পাত্র বা পাত্রীপক্ষের বাড়িতে বসতেন, তখন সেই ডায়রি খুললেই যেন খুলে যেত ভাগ্যের চাকা।

চাপাবাজি নাকি মুন্সিয়ানা?
সনাতন ঘটকদের কথার জাদুই ছিল আসল পুঁজি। তাদের মুখের কথাই ছিল শেষ কথা। তবে তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ‘মিষ্টি অভিযোগ’ ছিল বাড়িয়ে বলা বা স্থানীয় ভাষায় ‘চাপাবাজি’।
কালো মেয়েকে ফর্সা বানাতে ঘটক বলতেন, “মেয়ের গায়ের রং তো শ্যামলা নয়, যেন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ভোরের আলোর মতো।” আর বেকার ছেলের ক্ষেত্রে বলতেন, “ছেলে এখন একটু জিরোচ্ছে, তবে বাপের বিশাল সম্পত্তি দেখাশোনা করার জন্য তো একটা লোক লাগে, তাই না?”
পাত্রীপক্ষ বা পাত্রপক্ষ জানত ঘটক মশাই একটু বাড়িয়ে বলছেন, তবুও তার ওপরই ভরসা রাখতেন সবাই। কারণ, এই বাড়িয়ে বলার পেছনে কোনো ছলনা ছিল না, ছিল দুই হাত এক করে দেওয়ার অদম্য চেষ্টা।

পেশা নয়, পুণ্যের কাজ
সেকালের ঘটকরা ঘটকালিকে ঠিক ‘পেশা’ হিসেবে দেখতেন না। তারা মনে করতেন, দুটি মানুষের সংসার পাতানো মানে মহৎ ও পুণ্যের কাজ। টাকার বিনিময়ে কাজ করার মানসিকতা তখন ছিল না। বিয়ে পাকা হলে এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে যা পাওয়া যেত, তার নাম ছিল ‘ঘটক বিদায়’।
নতুন গামছা, ধুতি, পাঞ্জাবি, একটি ছাতা কিংবা সাধ্যমতো কিছু নগদ টাকা, এতেই তারা খুশি থাকতেন। আপ্যায়নে মিষ্টিমুখ আর পানের সমারোহেই তাদের তৃপ্তি ছিল।

সরেজমিন আলাপচারিতা: স্মৃতির পাতা থেকে
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের এক প্রবীণ বাসিন্দা, ৮৭ বছর বয়সী মো. সুরুজ মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। যৌবনে তিনি শখের বশে বহু বিয়ে দিয়েছেন।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফোকলা দাঁতে হেসে তিনি বলেন, “এখন তো দেখি পোলাপান মোবাইলে ছবি দেইখা পছন্দ করে। আর আমাগো আমলে আমি ছিলাম ‘বিনা পয়সার পোস্ট অফিস’। ছেলের বাপের কথা মেয়ের বাপের কানে পৌঁছাইতাম। কত মাইল যে হাঁইটা গেছি, তার হিসাব নাই। রোদ নাই, বৃষ্টি নাই—খবর আদান-প্রদান করাই ছিল কাজ।”

তিনি আরও বলেন, “একবার এক ছেলের বিয়ে ঠিক করতে তিন জোড়া জুতা ক্ষয় করছিলাম। ছেলের বাপ একটু কড়া মেজাজের ছিল, আর মেয়ের বাপ ছিল কৃপণ। দুইজনকে ম্যানেজ করা কি মুখের কথা? মিথ্যা কইব না, একটু বানাইয়া কথা কইতাম। কইতাম—‘ছেলের মেজাজ গরম না, আসলে ও খুব ব্যক্তিত্ববান’। এইটুকু মিথ্যা না কইলে তো সংসার পাতা যাইতো না। কিন্তু এখনকার মতো ধোঁকাবাজি তখন ছিল না। আমরা বংশমর্যাদা আর পারিবারিক সম্মানটা সবার আগে দেখতাম।”

হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য
আজকের যুগে বায়োডাটা, ছবি এডিট করা প্রোফাইল আর ভিডিও কলের ভিড়ে সেই ছাতা হাতে, পান চিবানো ঘটক মশাইরা হারিয়ে গেছেন। এখন আর কেউ বগলে কালো ডায়রি নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটেন না। তবুও বাংলার বিয়ের ইতিহাসের পাতা উল্টালে এই মানুষগুলোর ঘাম আর পরিশ্রমের গন্ধ পাওয়া যায়। তারা শুধু বিয়েই দিতেন না, তারা ছিলেন সমাজের অঘোষিত সেতুবন্ধন।