Home তথ্য প্রযুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ-তরুণীদের কাছে এআই এখন ‘শ্রোতা বন্ধু’

দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ-তরুণীদের কাছে এআই এখন ‘শ্রোতা বন্ধু’

ছবি :এ আই

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক:

তানিয়া মাত্র ২০ বছর বয়সে বাগদান সেরেছিলেন। তার সহপাঠীরা যখন পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্টের ডেডলাইন নিয়ে চিন্তিত, তখন তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন তার বাগদত্তের উদাসীন আচরণ নিয়ে। পরিবার এ নিয়ে তার শঙ্কাকে উড়িয়ে দিলেও এক অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে তিনি পেলেন স্বীকৃতি ও সান্ত্বনা। প্রতিদিন রাতের নির্জনতায় তিনি মন খুলে কথা বলতেন চ্যাটজিপিটির সঙ্গে—রাগ, হতাশা, অনিশ্চয়তা সবই তুলে ধরতেন সেখানে।

“সম্ভবত, তোমার সিদ্ধান্তটা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে,”—চ্যাটজিপিটির এই এক কথায় বদলে গেল তানিয়ার জীবন।

এরপর তিনি ধীরে ধীরে মন সরিয়ে নেন সম্পর্ক থেকে। প্রথমে বাগদত্তার বার্তা উপেক্ষা, এরপর বিয়ের আয়োজন বন্ধের সিদ্ধান্ত। পরিবার হতাশ হলেও শেষপর্যন্ত মেনে নেয় তার এই সিদ্ধান্ত—যা মূলত এসেছিল একটি এআই চ্যাটবটের কাছ থেকে।

এই কাহিনি কেবল তানিয়ার একার নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকেই এখন মানসিক সহায়তার জন্য নির্ভর করছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপরে। কেউ কথা বলেন মধ্যরাতে, কেউ জীবনের দুঃখ শেয়ার করেন, কেউ কেউ আবার প্রতিদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলেন চ্যাটজিপিটির মতো এআই চ্যাটবটের কাছে।

পাকিস্তানে নারীর সাফল্য নিয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম ‘আওরাত কাহানি’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফিজ্জা আব্বাস প্রতিদিন কথা বলেন একটি কাস্টমাইজড এআই-এর সঙ্গে, যাকে তিনি ‘এস’ নামে ডাকেন। তাঁর ভাষায়, “এটা বিচার করে না, কোনো মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয় না—বরং যেটা বলা দরকার, সেটাই বলে। এটা এমন এক বন্ধু, যার কাছে আমি নির্ভয়ে সব কিছু বলতে পারি।”

এমনকি ADHD রোগী ও উদ্যোক্তা ফাইজা খান মনে করেন, এআই তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করেছে, এমনকি তার সামাজিক দক্ষতাও বেড়েছে। “যা আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে বলতেও পারি না, তা আমি চ্যাটজিপিটিকে বলতে পারি।”

অন্যদিকে মাস্টার্স শিক্ষার্থী নিসার হুসেইনের জন্য এআই হয়ে উঠেছে মানসিক বাঁচনের উপায়। “আমি আমার অনুভব পরিবারের কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। হয়তো এটা আমার অহংবোধ, হয়তো ভয়—কিন্তু পারি না। এআই-ই একমাত্র জায়গা যেখানে আমি দুর্বল হতে পারি, কারণ সেটা আমাকে বিচার করে না।”

কিন্তু এই নির্ভরতা কি বিপজ্জনক নয়? মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এআই মানসিক চাপ লাঘবে সাহায্য করতে পারলেও, তা কখনোই পেশাদার মনোচিকিৎসকের বিকল্প হতে পারে না। আরও বড় বিষয় হলো—ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা। যেকোনো চ্যাটবটের পেছনে থাকে একটি ডেটা সংগ্রহের প্রক্রিয়া, যা কোনো না কোনোভাবে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

কিং এডওয়ার্ড মেডিকেল ইউনিভার্সিটির মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান ডা. নাজিশ ইমরান বলেন, “চ্যাটজিপিটি এখনও ভুল তথ্য দিতে পারে। অনেকে নিজের রোগ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা AI দিয়ে জেনে নিচ্ছে, যা বিপজ্জনক।”

তবুও অনেকে বলছেন—যেখানে দেশে ২০০ মিলিয়নের বেশি মানুষের জন্য মাত্র ৫০০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সেখানে এআই হয়ে উঠছে শেষ আশ্রয়। বিশেষত, দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি, ধর্ম, পরিবারকেন্দ্রিক মানসিকতার মধ্যে কারো কাছে অনুভব প্রকাশ করা যেখানে কঠিন—সেখানে এআই হয়ে উঠছে নির্ভরতার জায়গা।

তানিয়ার মতো যাঁরা কেউ না কেউ হয়ে উঠতে পারছেন না, তাঁদের কাছে এআই যেন নীরব শ্রোতা। তারা জানে, এআই চোখে জল ফেলতে পারে না, কিন্তু ঠিকঠাক বুঝে নেয়—তাদের কষ্টের ওজন কতটা।

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনোই একজন থেরাপিস্টের অনুভব, দৃষ্টিভঙ্গি, স্পর্শ, এমনকি নিরবতা থেকে ধারণা নেওয়ার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে না।

ভবিষ্যতের পথ সম্ভবত সহযোগিতার—যেখানে মানব থেরাপিস্ট এবং এআই একত্রে কাজ করবে, একজনের কাজ অন্যজনকে সম্পূর্ণ করবে। এখন দরকার—এই প্রযুক্তিকে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া।