Home খেলাধুলা জাহানারার ১৩ পৃষ্ঠার চিঠির যেসব অভিযোগে তোলপাড়

জাহানারার ১৩ পৃষ্ঠার চিঠির যেসব অভিযোগে তোলপাড়

জাহানারা আলম । ছবি সংগৃহীত

স্পোর্টস ডেস্ক: দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এখন তোলপাড়! পেসার জাহানারা আলমের গুরুতর যৌন হয়রানির অভিযোগ ঘিরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে ক্রিকেটাঙ্গনে। দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে যাওয়া নানা বঞ্চনা, গ্রুপিং এবং আপত্তিকর ঘটনার বিবরণ দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরীকে ১৩ পৃষ্ঠার এক বিস্ফোরক চিঠি দিয়েছেন এই তারকা ক্রিকেটার। ম্যানেজার, নির্বাচক ও নারী বিভাগের তৎকালীন ইনচার্জসহ কোচদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তিনি। ‘কালবেলা’র হাতে আসা সেই চাঞ্চল্যকর চিঠিটি প্রকাশ করে ক্রীড়াঙ্গনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিবেদক ওমর ফারুক।

যেভাবে শুরু ঘটনার সূত্রপাত:
চিঠির শুরুতেই জাহানারা উল্লেখ করেছেন তখনকার কো-অর্ডিনেটর সরফরাজ বাবুর সঙ্গে তার কথোপকথন। বাবু জাহানারাকে অনুরোধ করেছিলেন, দলের মধ্যকার সমস্যাগুলো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের মিলে সমাধান করতে হবে, কারণ সামনে বড় টুর্নামেন্ট। তৌহিদ ভাই (তৎকালীন ইনচার্জ) অনেক চেষ্টা করেছেন এবং তিনি নিজেও চাপে আছেন, এমনকি চাকরিও ছেড়ে দিতে পারেন। “দলে যদি কোনো ফাটল থাকে তো সিমেন্ট লাগানোর দায়িত্ব আপনাদের সিনিয়রদের। আপনি এটা আবার কারও সঙ্গে শেয়ার কইরেন না” – বাবু ভাই জাহানারাকে সতর্ক করেছিলেন। প্রত্যুত্তরে জাহানারা জানিয়েছিলেন, তৌহিদ মাহমুদ সব সমস্যা সম্পর্কে অবগত এবং তিনিই চাইলে সব ঠিক করতে পারবেন।

মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জুর বিরুদ্ধে অভিযোগ:
সেই ঘটনার পরপরই টিম ম্যানেজার ও নির্বাচক মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু জাহানারার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু করেন বলে অভিযোগ। চিঠির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় জাহানারা লিখেছেন, “মঞ্জু ভাই মাঠে আমার সঙ্গে অকারণে খারাপ ব্যবহার শুরু করেন। খুব চিৎকার এবং রূঢ়ভাবে কথা বলেন। আমি হকচকিত, বুঝলাম না আমার দোষটা কোথায়!” এরপর তৌহিদ মাহমুদকে ইন্টারভিউয়ের অনুমতি চেয়ে ফোন ও এসএমএস করেও কোনো উত্তর পাননি বলে জানান জাহানারা।

দলের ভেতরের গ্রুপিং ও সম্পর্কের জটিলতা:
তৃতীয় পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ গেমসের দল গঠন থেকে শুরু করে দলের মধ্যে গুরুতর গ্রুপিংয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন জাহানারা। তিনি লিখেছেন, “রুমানা তখনো ওয়ানডে দলের নিয়মিত অধিনায়ক। বাংলাদেশ গেমসের তিন দলের একটা সালমা আপু, একটা জ্যোতি ও অন্যটায় অধিনায়ক করা হয় শারমিনকে। সেখানে শারমিন কখনো কোনো ঘরোয়া লিগেও অধিনায়কত্ব করেনি। রুমানা এত মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে যে, ওই টুর্নামেন্টে সে পারফরম্যান্স করতে পারেনি। ওই টুর্নামেন্ট থেকে আমার, সালমা আপু ও রুমানার সঙ্গে টেকনিক্যালি খারাপ ব্যবহার শুরু হয় এবং সব জায়গায় জ্যোতির প্রাধান্য বাড়তে থাকে।”

গ্রুপিংয়ের অভিযোগ আরও গভীর হয় যখন জাহানারা দশম পৃষ্ঠায় দাবি করেন যে, জ্যোতির সঙ্গে পিংকির শুধু বন্ধুত্ব নয়, অন্য সম্পর্কও বিদ্যমান, যা নিয়ে কয়েকজনের মধ্যে মারামারির মতো ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, ১২তম পৃষ্ঠায় আরও গুরুতর অভিযোগ এনেছেন জাহানারা—জ্যোতি, পিংকি ও সুমনা মিলে আরেক ক্রিকেটার নুঝাত টুম্পার বিরুদ্ধে মেয়েদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক গড়ত। এসবের মধ্য দিয়েই দলে জ্যোতিদের প্রাধান্য তৈরি হয় বলে জানান তিনি।

অনুশীলন ও প্রচারণায় বৈষম্য:
জাহানারার অভিযোগ, অনুশীলন ম্যাচে নির্বাচক মঞ্জুর নির্দেশনা অমান্য করায় তাকে বোলিং করতে দেওয়া হয়নি। তিনি লিখেছেন, “আমাদের অনুশীলন ম্যাচে মঞ্জু ভাই ওয়াকিটকিতে বলেন জাহানারাকে ইয়র্কার করতে বলো। আমি ইয়র্কার চেষ্টা করতে গেলে বল লেগ মিডলে পড়ল। পরের বল গুড লেন্থে হলো কেন, উনার কথা শুনিনি তাই আবার ওয়াকিটকিতে অসম্ভব জোরে চিৎকার করে বললেন, ‘খবরদার জাহানারাকে আর যেন বল না দেওয়া হয়। অন্য যে কেউ করবে জাহানারা নয়! সালমা দেখ ব্যাপারটা।’”

সাংবাদিকদের ইন্টারভিউ দেওয়া বা যেকোনো প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য বোর্ডের অনুমতির প্রয়োজন হলেও, প্রয়াত ইনচার্জ তৌহিদ মাহমুদ নাকি জাহানারাকে এ ধরনের কাজে সহযোগিতা করতেন না। উল্টো বলা হতো জাহানারা ব্যস্ত, নতুনদের সুযোগ ও প্রমোট করার জন্য। জিম্বাবুয়ে সফরের আগে তৌহিদ মাহমুদ জাহানারাকে বলেছিলেন, “তোমার নামে এত সুপারিশ এলে তো হবে না, অসংখ্য সাংবাদিক তোমার ইন্টারভিউ চায়। তোমার নাটকে অভিনয় করানোর জন্য সুপারিশ আসে—এগুলো ঠিক না। খেলায় ফোকাস করো, সামনে গুরুত্বপূর্ণ সফর করতে হবে।”

অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধাতেও বৈষম্যের অভিযোগ করেছেন জাহানারা। তিনি লিখেছেন, “বিগত ১০-১১ মাস ইমন স্যার (সাবেক কোচ), ফারুক ভাই (বর্তমান ব্যাটিং কোচ), আমাকে মাত্র ৫-৬ দিন আলাদা ব্যাটিং ড্রিল করিয়েছেন অল্প করে। কারণ, তারা সব সময় জ্যোতি, পিংকি, হ্যাপিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটিং ড্রিল করাত।” মঞ্জুর বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিল, তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের বেশি সময় পেস বোলিং অনুশীলন করানো হতো।

বিসিবির সিইও’র কাছে আকুতি:
১৩ পৃষ্ঠার এই চিঠির শেষ পাতায় জাহানারা বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরীর কাছে আকুতি জানিয়ে লেখেন, “আমাকে মানসিকভাবে (মেন্টালি) টর্চার থেকে বাঁচান দয়া করে স্যার, কীভাবে দল গঠন হবে কাকে অধিনায়ক করা হবে, কারা কোচিং স্টাফে থাকবে, কারা অফিসিয়াল থাকবে তা সম্পূর্ণ বিসিবির ব্যাপার। আমি শুধু আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুটা লিখে জানালাম। আমি শুধু আমার দেশের জন্য পারফর্ম করতে চাই স্যার।” যদিও চিঠির বিভিন্ন অংশে তিনি সাবেক পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনের প্রশংসাও করেছেন।

দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নারী ক্রিকেটারের এমন গুরুতর অভিযোগ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, বিসিবি এই অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে কী পদক্ষেপ নেয় এবং কীভাবে নারী ক্রিকেটারদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করে।