টোটো উপজাতি: বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে একটি লড়াকু জাতিসত্তা
কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরের এক নির্জন পাহাড়ি কোণে, ভুটান সীমান্ত সংলগ্ন আলিপুরদুয়ার জেলার তাসতি ও মাদারিহাট ব্লকের মধ্যে বাস করে এক অনন্য উপজাতি—টোটো। সংখ্যায় ক্ষুদ্র, সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এই জনগোষ্ঠী আজও টিকে আছে তাদের শতাব্দী পুরনো নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য ও সামাজিক গঠনের মাধ্যমে, যদিও আধুনিকতার স্রোতে হারিয়ে যাওয়ার হুমকি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
অস্তিত্বের প্রান্তে এক জাতি
টোটোরা এতটাই বিরল যে ভারত সরকার তাদের “প্রিমিটিভ ট্রাইবাল গ্রুপ” বা “বিশেষভাবে দুর্বল আদিবাসী গোষ্ঠী (PVTG)” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১,৫০০—এখন তা কিছুটা বেড়েছে বটে, তবে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কাটেনি।
টোটোরা মূলত টোটোপাড়া নামক একটি ছোট্ট গ্রামে বাস করে, যা ভূটানের জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। সীমান্তবর্তী এই এলাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন, আর এটাই তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে এতদিন ধরে কিছুটা হলেও রক্ষা করে রেখেছে।
ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য
টোটো ভাষা একটি স্বতন্ত্র টিবেটো-বর্মান ভাষা, যার কোনো লিপি নেই। তারা নিজেদের মধ্যে এই ভাষায় কথা বললেও বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বাংলাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য ভাষা রক্ষার প্রয়াস হিসেবে রোমান হরফে টোটো ভাষাকে লিখিত রূপ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
তাদের পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস এবং ধর্মীয় বিশ্বাসও ব্যতিক্রমধর্মী। টোটোরা প্রকৃতিকে উপাসনা করে, এবং তাদের ঐতিহ্যগত দেবতা ‘ইশপু’ ও ‘চুমু’—যারা মূলত প্রকৃতির শক্তির প্রতীক—তাদের জীবনধারার কেন্দ্রবিন্দু।
জীবনধারা ও সামাজিক কাঠামো
টোটোদের জীবনযাপন প্রধানত কৃষিভিত্তিক। তারা ধান, ভুট্টা, সবজি ও ফলমূল চাষ করে। এছাড়া পশুপালনও তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। টোটোদের ঘর নির্মিত হয় কাঠ ও বাঁশ দিয়ে, ছাদে ব্যবহার হয় খড় বা টিন। একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর বিয়ের প্রবণতা ছিল, যাতে তাদের জাতিগত পরিচয় রক্ষা পায়। তবে বর্তমান প্রজন্মে এই ধারা কিছুটা শিথিল হয়েছে।
আধুনিকতার ছায়া ও সংকট
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে টোটোপাড়ায় বিদ্যুৎ, সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলেও টোটো জাতিগোষ্ঠীর কাছে আধুনিকতা অনেকটাই অচেনা। উচ্চশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থান এখনও তাদের নাগালের বাইরে। একদিকে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষয়, অন্যদিকে যুবসমাজের মধ্য থেকে মূল ধারায় মিশে যাওয়ার প্রবণতা—এই দুই বিপরীত স্রোতের মাঝে টোটোদের অস্তিত্ব আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
রক্ষার প্রচেষ্টা ও ভবিষ্যতের ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা টোটোদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় কাজ করছে। স্থানীয় স্কুলে টোটো ভাষা শেখানো শুরু হয়েছে, কিছু গবেষক এই ভাষার অভিধান রচনার কাজেও যুক্ত। তবে এই উদ্যোগগুলো বৃহৎ পরিসরে চালু না হলে, টোটোদের অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বাধ্য।
এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার লড়াই যেন শুধুই তাদের নয়—এটি মানবজাতির বৈচিত্র্য রক্ষার সংগ্রাম। টোটোরা আছে, মানে মানবসভ্যতার আরও এক বর্ণময় অধ্যায় এখনো জীবিত।
এমন আরও প্রতিবেদন পড়তে চোখ রাখুন businesstoday24.com এ।