বিজনেসটুুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রস্তাব ব্যবসায়ী সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাদের দাবি, এমন সিদ্ধান্ত বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা, আমদানি–রপ্তানির অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে একেবারেই অযৌক্তিক। বন্দর কর্তৃপক্ষ যেখানে অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয়ের কথা বলছে, সেখানে ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরেই মুনাফায় চলছে—তাহলে হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের যুক্তি কোথায়?
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। দেশের ৯২ শতাংশ আমদানি ও ৮৫ শতাংশ রপ্তানি এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এমন পরিস্থিতিতে ট্যারিফের আকস্মিক বৃদ্ধি শুধু ব্যবসায়ীদের নয়, পুরো অর্থনীতিকেই চাপের মুখে ফেলতে পারে। ব্যবসায়ী মহল আশঙ্কা করছে, নতুন মাশুল কার্যকর হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে পণ্যমূল্য ও আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি প্রতিযোগিতায়।
ব্যবসায়ী নেতারা অভিযোগ করেছেন, ট্যারিফ বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই। চিটাগং চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বন্দর নিয়ে যে খেলা শুরু হয়েছে, তা চলতে দেওয়া হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে এত তাড়াহুড়ো করে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেন?” তার মতে, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো সেবা প্রতিষ্ঠানের নীতিগত পরিবর্তন অবশ্যই আলোচনা ও মূল্যায়নের মাধ্যমে হওয়া উচিত।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, “বন্দর প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা লাভ করে। তবু ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর উদ্যোগ অযৌক্তিক। আমরা কি গোলাম? আমাদের টাকায় আপনারা প্রতিষ্ঠান চালান, অথচ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আমাদের ছাড়া!” তিনি স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
বিজিএমইএ, শিপিং এজেন্ট এবং সি অ্যান্ড এফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা রবিবারের প্রতিবাদ সভায় বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার খরচ (Cost of Doing Business) ইতিমধ্যেই প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এমন বাস্তবতায় ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বন্দর মাশুল বাড়ানো হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সেলিম রহমান মনে করেন , “ভিয়েতনাম, ভারত বা মালয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের খরচ অনেক বেশি। ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে সেই ব্যবধান আরও বাড়বে, যা রপ্তানিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এমন এক অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে যেখানে ব্যবসা খরচ বাড়ানো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংক খাতে ঋণচাপ ও বিনিয়োগ স্থবিরতার এই সময়ে ট্যারিফ বৃদ্ধি ব্যবসায়িক আস্থা আরও কমিয়ে দিতে পারে।
অন্যদিকে বেপজিয়া, বারভিডা, এবং অন্যান্য সংগঠনের নেতারা বলেন, সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এখন ব্যবসায় ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা মনে করেন, বন্দর ট্যারিফ বাড়ালে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। আমদানি ব্যয় বাড়লে রপ্তানির উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাবে, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্দর পরিচালনার কাঠামোতেও সংস্কার প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি বা স্বাধীন পরিচালক না থাকায় অনেক সময় বন্দর প্রশাসন এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে আস্থা সংকট সৃষ্টি করে। ব্যবসায়ীরা তাই দাবি করছেন—বন্দর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, এই ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যয় ৮–১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে পোশাক খাতে ভিয়েতনাম, ভারত ও কম্বোডিয়া ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বিকল্প হয়ে উঠছে, সেখানে খরচ বাড়িয়ে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। এর পাশাপাশি বন্দরে পণ্য খালাসে সময় বাড়বে, পরিবহন খরচ বাড়বে এবং ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকেরা আরও চাপে পড়বেন।
সভায় বক্তারা বলেন, বন্দরকে কস্ট-বেইজড ট্যারিফ পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে রাজস্বের সঙ্গে সেবার ভারসাম্য থাকে। তাদের মতে, আড়াই হাজার কোটি টাকা লাভ করা প্রতিষ্ঠান নতুন মাশুলের অজুহাত দেখিয়ে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে না।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এ সিদ্ধান্ত কেবল অর্থনৈতিক নয়—এতে রাজনৈতিক অস্থিরতাও যুক্ত। অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত মেয়াদে এমন বড় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রশাসনিক তাড়নার ইঙ্গিত দেয়। ফলে ব্যবসায়ীরা এখন প্রশ্ন তুলছেন—এই সিদ্ধান্ত কি অর্থনীতির প্রয়োজন, নাকি আমলাতান্ত্রিক চাপের প্রতিফলন?
সবশেষে, অর্থনীতিবিদরা বলছেন—বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশ এখন স্থিতিশীলতার প্রয়োজন অনুভব করছে, নতুন চাপ নয়। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র; এখানে ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্তই অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে পারে। সরকার ও বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি ব্যবসায়ী সমাজের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছায়, তবে ক্ষণিকের উত্তেজনা কাটিয়ে দেশের বাণিজ্য আবারও স্বস্তির পথে ফিরতে পারে।