বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: বৃষ্টিহীন দীর্ঘ সময়, দিনে দিনে বেড়ে চলা তাপমাত্রা এবং প্রাকৃতিক ছায়া বা পানির উৎসের অভাবে শুধু মানুষ নয়, তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গবাদিপশু ও পোলট্রির খাত। দেশের উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাঠের গরু থেকে শুরু করে খামারের মুরগি—সবাই গরমে কাবু। একদিকে উৎপাদন হ্রাস, অন্যদিকে প্রাণীর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন দেশের হাজারো খামারি।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এবং ফরিদপুর-শরীয়তপুর অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে, দিনের প্রচণ্ড গরমে গবাদিপশু ছায়া খুঁজে আশ্রয় নিচ্ছে পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি কিংবা গাছপালায় ঘেরা স্থানে। শরীয়তপুরে দেখা গেছে, ফসলী মাঠে শতাধিক গরু-ছাগল মাঠজুড়ে বিচরণ করছে। দুপুরের দিকে তারা আশ্রয় নিচ্ছে নির্জন ছায়াঘেরা পরিত্যক্ত বাড়িতে। স্থানীয়রা জানান, গবাদিপশুদের এই অবাধ বিচরণে বজ্রপাতের ঝুঁকিও বাড়ছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, তীব্র তাপপ্রবাহে পশুরাও হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে। দিনে বারবার গোসল করানো, পর্যাপ্ত পানি খাওয়ানো এবং ছায়া নিশ্চিত করতেই খামারিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
দুধ উৎপাদনের অন্যতম অঞ্চল সিরাজগঞ্জে খামারিরা বলছেন, গরমে গরু দুধ কম দিচ্ছে। শাহজাদপুরের খামারি মমতাজ উদ্দিন জানান, তার খামারে আগে প্রতিদিন ৮-৯ মন দুধ মিললেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ মনের নিচে। গরমে গরুরা হাঁসফাঁস করে, আর ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করালে ঠান্ডাজনিত অসুখ দেখা দিচ্ছে।

চরাঞ্চলে বাথান নিয়ে যাওয়া খামারিরা জানাচ্ছেন, মহিষগুলোকে দিনে বেশির ভাগ সময় পানিতে রাখতে হচ্ছে। ছায়ার অভাবে তারা দিনভর কষ্ট পাচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পোলট্রি খাতেও গরমে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা প্রকট। প্রতিদিন অসংখ্য মুরগি মারা যাচ্ছে। হরিনহাটা গ্রামের খামারি এস এম তফিজউদ্দিন বলেন, ‘তাপদাহে মুরগি খাবার খাচ্ছে না, শুধু পানি খাচ্ছে—তাও পর্যাপ্ত নয়।’ রকি নামের আরেক খামারি জানান, তার খামারে থাকা ৪০ হাজার মুরগির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে।
এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। মুরগির উৎপাদন কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। সিরাজগঞ্জের বড়বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ইমান আলী জানান, সরবরাহ কম থাকায় তারা আগের মতো কিনতে পারছেন না। এতে করে খুচরা বাজারেও দাম বাড়ছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ দফতরগুলো খামারিদের সচেতন করতে মাঠে কাজ শুরু করেছে। গরুকে দিনে তিনবার গোসল করানো, পর্যাপ্ত পানি ও খাবার নিশ্চিত করা, ছায়া বা খোলা জায়গায় রাখা এবং ঘরের চালে পানি ছিটিয়ে তাপমাত্রা কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রাণির স্বাভাবিক চক্র ব্যাহত হওয়ায় দুধ ও ডিমের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
সিরাজগঞ্জের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এ কে এম আনোয়ারুল হক বলেন, “জেলায় এখন পর্যন্ত বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি, তবে তাপপ্রবাহ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।”
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের চূড়ান্ত প্রভাব এখন কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতে দৃশ্যমান। নিয়মিত বৃষ্টির অভাব, অনিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অভাবে প্রাণিকুল সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে। তাদের মতে, খামার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি না থাকলে এই সংকট আরও প্রকট হতে পারে।