সাইয়েদ আহমেদ: উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশখন্দে পা রাখতেই যে অনুভূতিটা মনকে ছুঁয়ে যায়, তা হলো এই শহর কেবল প্রাচীন ইতিহাস আর স্থাপত্যের সমাহার নয়, বরং এখানকার খাদ্যসংস্কৃতিও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলা এক জীবন্ত ঐতিহ্য। প্রাচীন সিল্ক রোডের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই দেশটি তার সমৃদ্ধ গ্যাস্ট্রোনমিক ঐতিহ্যের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত, যা গভীরভাবে ইসলামি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়ায় এখানে ‘হালাল’ খাবারের নিশ্চয়তা ভ্রমণকারীদের জন্য এক বাড়তি স্বস্তি এনে দেয়।
তাশখন্দ জুড়ে রয়েছে অগণিত ঐতিহাসিক নিদর্শন—আমির তেমুর মিউজিয়াম, খাস্ত-ইমাম কমপ্লেক্স, মাইনর মসজিদ, বারাক-খান মাদ্রাসা—আর শহরের বাইরে সামরকন্দ, বুখারা ও খিভার মতো আরও অনেক ঐতিহাসিক শহর। কিন্তু এই ইতিহাসের অলিন্দে ঘুরে বেড়ানোর পর যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি মনে গেঁথে যায়, তা হলো এখানকার খাবারের অপূর্ব স্বাদ।
ছগাতাইয়ের রুটি সুবাসে সকাল
আমার প্রথম সকাল শুরু হয়েছিল ছগাতাই এলাকায়, যা তার বিখ্যাত রুটির জন্য পরিচিত। সরু গলি, প্রাচীন মসজিদ আর হাজরাতি ইমাম কমপ্লেক্সের পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে নাকে ভেসে আসে সদ্য বেক করা রুটির ম ম গন্ধ—এখানে যা ‘নন’ বা ‘লেপেশকা’ নামে পরিচিত। প্রতিটি কোণায় ছোট ছোট বেকারি, আর সেখানেই টগবগে তন্দুরে তৈরি হচ্ছে গরম রুটি। অদ্ভুত এক দৃশ্য চোখে পড়ে—কেউ কেউ শিশুর বেবি ক্যারেজে কাপড় মুড়িয়ে তাতে রুটি সাজিয়ে বিক্রি করছেন।
স্থানীয় এক গ্রাহক জানালেন, “নন দুই রকম—ওবি (সাধারণ) আর পাতির (তিল ছড়ানো)। উজবেক ঘরে রুটি শুধু খাবার নয়, এটি এক সৌন্দর্যের প্রতীকও।” দুধ, মাখন, ইস্ট, চিনি আর লবণ মিশিয়ে তৈরি মণ্ডকে কাঠের ছাপ (চেকিচ) দিয়ে অলংকৃত করা হয়, এরপর জ্বলন্ত তন্দুরের দেয়ালে সেঁকা হয়। ফলাফল—নরম, তুলতুলে, অথচ দৃঢ় টেক্সচারের এক স্বর্গীয় রুটি।
চোরসু বাজারের রঙ ও ঘ্রাণ
তাশখন্দে এসে চোরসু বাজার না দেখলে সফর অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বিশাল নীল গম্বুজের নিচে এই বাজারের একতলায় মাংস বিক্রি হয়, ওপরের তলায় শুকনো ফলের ব্যবসা চলে, আর চারপাশজুড়ে ফল, সবজি, মৃৎশিল্প, গয়না—সবকিছুই একসঙ্গে পাওয়া যায়। বাদাম, কিশমিশ, পেস্তা—সবকিছুই এখানকার নিজস্ব স্বাদে ভরপুর। বিক্রেতারা হাসিমুখে অফার করেন, আর দরদাম চলে প্রাণখোলা ভঙ্গিতে। উজবেক বাদাম ফেটে গেলে শোনা যায় ক্রিম ব্রুলের মতো মিষ্টি আওয়াজ; এখানকার পেস্তা বড় আর লবণাক্ত। একবার গেলে চার-পাঁচ কেজি শুকনো ফল না নিয়ে ফেরা যেন এক অপরাধ!
শাশলিক মার্কেটের ধোঁয়ায় ঘেরা দুপুর
চোরসুর পাশেই শাশলিক মার্কেট—পুরো এলাকা জুড়ে ধোঁয়ার ভেতর ভেসে আসে গ্রিল করা মাংসের সুঘ্রাণ। ল্যাম্ব স্কিউয়ার, গরুর কাবাব, ভাজা মাছ—সবকিছুই এখানে বেশ জনপ্রিয়। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ খাবার ছিল ‘খানুম’—আলু ও পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি একধরনের স্টিমড ডাম্পলিং। কাঁচা পেঁয়াজ, ডিল ও সবুজ মরিচের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে এর স্বাদ বহুগুণে বেড়ে যায়।
সোমসা ও পিলাফের গল্প
তাশখন্দ মলের ঐতিহ্যবাহী ‘বোবয় ক্যাফে’-তে আমি বিখ্যাত ‘সোমসা’ খেলাম—মাংস ভর্তি খাস্তা পেস্ট্রি, যা দক্ষিণ এশিয়ার সামোসার পূর্বসূরী। গরুর কিমা, জিরা, কালো মরিচ ও মরিচের ঝাঁজে ভরা এই খাবারটি ছিল এক কথায় অনবদ্য।
শেষ দিনে আমি যাই ‘বেশ কজন’ রেস্তোরাঁয়, যা তাশখন্দের সবচেয়ে জনপ্রিয় পিলাফ কেন্দ্র। বিশাল কড়াইয়ে ধীরে ধীরে সেদ্ধ হচ্ছে চাল, মাংস, গাজর, ছোলা, বেরি আর জাফরান। আমি অর্ডার করলাম ঝাল পিলাফ—মেষ, গরু ও ঘোড়ার মাংস (কাজি) সহ। গোল্ডেন চালের ওপর ভাসছে মাংসের রস, গাজরের মিষ্টি স্বাদ, আর ঘোড়ার সসেজের হালকা লবণাক্ততা—সব মিলিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
বিদায়ের আগে শেষ চামচ
উজবেকিস্তানে আমার চার দিনের ভ্রমণ শেষ হয় পিলাফের শেষ চামচে। তাশখন্দ আমাকে শিখিয়েছে—ইতিহাস কেবল স্থাপত্যে নয়, খাবারেও বেঁচে থাকে। আর সেই স্বাদ একবার গ্রহণ করলে, তা স্মৃতির মতো চিরস্থায়ী হয়ে যায়।