বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক কাঠামোকে ‘চোরতন্ত্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, “আমলা, ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদরা মিলে আওয়ামী লীগের শাসনামলে চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন রাজনীতিবিদরা মুছে যাচ্ছেন, ব্যবসায়ীরা ঝিমিয়ে পড়ছেন, আর আমলারা শক্তভাবে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছেন।”
আজ সোমবার (১৯ মে) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৫-২৬: নীতি সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক এক বহুপাক্ষিক অংশীজন বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নিজেই।
তিনি বলেন, “গত ১৫ বছরে অর্থনীতির যা ছবি ফুটে উঠেছে, তা শুধুমাত্র পরিসংখ্যানে বোঝা যাবে না। বাস্তবে এটি আমলানির্ভর ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনীতির মুখ্য ভূমিকা হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে। এর ফলে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনস্বার্থ অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে।”
দেবপ্রিয় আরও জানান, সিপিডির শ্বেতপত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভক্ত করার প্রস্তাব ছিল বহু আগেই। কিন্তু হঠাৎ করেই এনবিআরকে দুই ভাগে ভাগ করার পদ্ধতিকে তিনি স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণহীন বলে আখ্যা দেন।
তিনি বলেন, “দুইভাগ করা ঠিক হয়েছে, কিন্তু যেভাবে করা হয়েছে, তা ভুল। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী মহলকে সম্পৃক্ত না করে এবং প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনের জায়গাগুলো সংকুচিত করে এটি করা হয়েছে। এখন সঠিক কাঠামো তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ।”
জাতীয় অর্থনীতির বর্তমান চিত্র তুলে ধরে দেবপ্রিয় বলেন, “দেশে বেকারত্ব বেড়ে ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে, অথচ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির তুলনায় অনেক কম। ফলে ক্রয়ক্ষমতা ও জীবিকায় চাপে পড়ছে সাধারণ মানুষ। বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং আস্থাহীনতার কারণে প্রবৃদ্ধিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।”
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি হয়তো আর বিনিয়োগনির্ভর হবে না, বরং তা ভোগতাড়িত হবে। একইসঙ্গে, তিনি মুদ্রানীতির অকার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। বলেন, “মূল্যস্ফীতি যদি ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে না আসে, তাহলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে।”
বৈঠকে অংশ নেওয়া রাপিডের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ বলেন, “আমরা আশা করছি, এবার একটি ভিন্নধর্মী বাজেট আসবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাজেট প্রণয়ন করছে, যারা ইতিপূর্বে এই বিষয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ইতিমধ্যেই বাজেটের আকার কমানো, প্রকল্প সংখ্যা হ্রাস ও এডিপির কাটছাঁট—এগুলোর মধ্যে কিছু প্রতিফলন দেখা গেছে।”
তিনি কর্মসংস্থানের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, “শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের মুখ্য অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। রাজস্ব আয়ের ওপর বেশি জোর দিতে হবে, ঋণনির্ভরতা কমাতে হবে।”
কর-জিডিপি অনুপাতে বর্তমান লক্ষ্যমাত্রা ‘অত্যন্ত নিচু’ উল্লেখ করে আবু ইউসুফ বলেন, “২০৩৫ সাল পর্যন্ত যদি মাত্র ১০ দশমিক ৫ শতাংশ কর-জিডিপি লক্ষ্য ধরা হয়, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এটি অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত।”
বৈঠকে আরও উঠে আসে, দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ঘুরে দাঁড়াবে কিনা, তা নির্ভর করছে সুস্পষ্ট নীতি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা ও কার্যকর বাজেট বাস্তবায়নের ওপর।