Home আন্তর্জাতিক নারীস্বাস্থ্য: স্বামীর অনুমতি ছাড়া চিকিৎসা বন্ধ পাকিস্তানে

নারীস্বাস্থ্য: স্বামীর অনুমতি ছাড়া চিকিৎসা বন্ধ পাকিস্তানে

লাহোর: ২৮ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা ও গবেষক মারিয়াম দীর্ঘদিন ধরে এন্ডোমেট্রিয়োসিসে ভুগছেন — একটি শারীরিক অবস্থার কারণে যন্ত্রণা অতীব তীব্র। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদ্ধতি জানা এবং অর্থের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও লাহোরের একটি প্রাইভেট হাসপাতাল তাঁকে চিকিৎসা দিচ্ছে না। সমস্যা? তিনি অবিবাহিত এবং হাসপাতাল তার “অস্তিত্বহীন” স্বামীর অনুমতি ছাড়া চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেছে।

মারিয়ামের গল্পটি একক ঘটনা নয়। পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে, নারীদেরকে প্রজনন স্বাস্থ্য, ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা এবং জরুরি শল্যচিকিৎসা পর্যন্ত পেতে গেলে পুরুষ সদস্যের অনুমতি নিতে বলা হয়। এই প্রথা শুধুমাত্র সামাজিক মনোভাবের প্রতিফলন নয়, বরং এটি নারীদের ক্ষমতাহীন করে তোলে — প্রথমে পরিবারে, পরে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়।

চিকিৎসা “গেটকিপিং”

২০২৪ সালের জাতিসংঘ জাতীয় উন্নয়ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে মাত্র ১২% নারী নিজের চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম, যখন ১৭% পরিবারের প্রধানের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। ২৮% নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অন্যান্য পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে পরামর্শ করে। চরমভাবে, ৪২% নারী জানিয়েছেন যে পরিবারের সকলেই সিদ্ধান্ত নেয়, রোগী ছাড়া।

গ্রামীণ অঞ্চলে এই প্রবণতা আরও তীব্র, যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রায়শই সীমিত।

স্বাস্থ্য অধিকার না পাওয়া = অর্থনৈতিক ক্ষতি

নারীদের শারীরিক স্বায়ত্তশাসন না থাকলে শুধু তাদের অধিকার লঙ্ঘন হয় না, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণও ব্যাহত হয়। দেশটির অর্ধেক জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারালে, ক্ষতি গৃহ, অর্থনীতি এবং জাতীয় উৎপাদন সবকিছুর ওপর পড়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন পাকিস্তানে ২৭ জন মা এবং ৬৭৫ নবজাতক preventable জটিলতায় মারা যায়। বার্ষিকভাবে, এটি প্রায় ২৪৬,০০০ নবজাতকের মৃত্যু এবং ৯,০০০ মা মারা যাওয়া নির্দেশ করে।

ব্যবস্থাগত ব্যর্থতা

স্বামী বা পরিবারের অনুমতি নেওয়ার প্রথা শুধুমাত্র প্রাচীন মনোভাবের ফল নয়, বরং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোগত ব্যর্থতারও প্রতিফলন। প্রাপ্তবয়স্ক নারীর চিকিৎসার জন্য কোনো জাতীয় আইন নেই, তবে হাসপাতালগুলো নিজেদের নিয়ম আরোপ করছে।

পাকিস্তানের সরকারি স্বাস্থ্য খরচ পেছনে থেকে ১% জিডিপির মধ্যে সীমাবদ্ধ, ফলে গ্রামীণ ক্লিনিকের কর্মী সংকট এবং শহরের হাসপাতালে রোগীর ভিড় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রজনন স্বাস্থ্য সেবাগুলো, যেমন এন্ডোমেট্রিয়োসিস, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS), গর্ভপাতের যত্ন, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় নেই।

আইনি অনুমতি থাকলেও, সামাজিক রীতিনীতি এবং চিকিৎসক-দ্বারা সমালোচনা নারীদের চিকিৎসা পাওয়া কঠিন করে তোলে। শুধুমাত্র ৪৬.৯% চিকিৎসক নারী, ফলে নারীরা চিকিৎসা খুঁজতে ঝুঁকছে না, বিশেষ করে যেখানে পর্দার নিয়ম প্রাধান্য।

পাকিস্তান ২০২৫ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ সূচকে ১৪৬ দেশের মধ্যে সর্বশেষ অবস্থানে রয়েছে, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ১৩১তম।

স্বায়ত্তশাসন হারালে মূল্যবান ক্ষতি

নারী যখন সময়মতো চিকিৎসা পান না, কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ সীমিত হয়। চিকিৎসা না পাওয়া প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা, কর্মদিবস হারানো এবং নির্ভরতা বাড়ে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের নারী শ্রমিক অংশগ্রহণ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম, ১৯৯০ সালে ১৩.৯৫% থেকে ২০১৯ সালে মাত্র ২১.৬৭% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা না পাওয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ।

পরিবর্তনের আহ্বান

নারীদের চিকিৎসা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় প্রোটোকল জরুরি। প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা শহরের বড় হাসপাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও প্রসারিত করতে হবে।

চিকিৎসক এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার যাতে তারা সম্মানজনক, অবিচল এবং অযৌক্তিক নিন্দা থেকে মুক্ত সেবা দিতে পারেন। নারী চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোও জরুরি, যাতে নারী রোগীদের জন্য সুবিধা নিশ্চিত হয়।

সামাজিক মনোভাব পরিবর্তন করাও অপরিহার্য। নারীরা স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হাসপাতাল ভিজিটের জন্য কোনো অনুমতি চাইবেন না। জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা সক্ষম সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

নারীদের স্বায়ত্তশাসন ব্যাহত হলে, পরিবার দুর্বল হয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অতিভারিত হয় এবং জাতীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এটি কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা বা লিঙ্গ ইস্যু নয় — এটি জাতীয় উন্নয়নের ব্যর্থতা। পাকিস্তান আর কতক্ষণ এই ক্ষতি বহন করতে পারে, সেটিই প্রশ্ন।

-সূত্র: ডন