ফিচার প্রতিবেদন
তারিক-উল-ইসলাম:
হায়দরাবাদের রাজপ্রাসাদের আলো যখন নিভে গেল, রাজদরবারের সোনার সিংহাসন যখন শুধু স্মৃতিতে রয়ে গেল, তখন মুকাররম জাহ জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নেন, নিজ ভূমি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর। যে রাজা একসময় কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক ছিলেন, যাঁর শাসনপ্রাসাদ ছিল ঐশ্বর্যের প্রতীক, সেই রাজা ধীরে ধীরে পরিণত হন এক নির্বাসিত মানুষের প্রতিচ্ছবিতে।
ষাটের দশকের শেষভাগে তিনি প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া যান। রাজ্যের পতনের পর দেশের রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা ছিল অপ্রাসঙ্গিক, আর প্রাসাদে থাকা কঠিন হয়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক চাপে। তিনি নতুন জীবন শুরু করতে চাইলেন নতুন মহাদেশে—একটি জীবনের খোঁজে যেখানে রাজকীয় পদবী নয়, বরং পরিশ্রম হবে তাঁর পরিচয়।
অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের দূরবর্তী অঞ্চলে তিনি একটি বিশাল ফার্ম কেনেন, নাম দেন “Endeavour Station।” সেখানে তিনি গরু, ভেড়া ও ঘোড়া পালনের ব্যবসা শুরু করেন। রাজপ্রাসাদের আরামদায়ক জীবন থেকে এসে এই অচেনা প্রান্তরে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। দিনের পর দিন তিনি মাঠে কাজ করেছেন, ট্রাক চালিয়েছেন, কখনো নিজ হাতে পশুপালনের যত্ন নিয়েছেন। সেই দৃশ্য—এক রাজা, যিনি রাজদণ্ড ছেড়ে ধরেছেন ফার্মের বেলচা, হয়তো ইতিহাসের এক গভীর রূপান্তরের প্রতীক।
তবু তাঁর এই উদ্যোগ টেকেনি দীর্ঘদিন। রাজকীয় সম্পদের একটি বড় অংশ তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন কৃষিকাজে, কিন্তু ব্যবসা ব্যর্থ হয়। অস্ট্রেলিয়ার কঠিন আবহাওয়া, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং আস্থাভাজন কর্মচারীদের প্রতারণা মিলিয়ে তাঁর সম্পদ দ্রুত হারাতে থাকে। এক সময় যে মানুষকে “মুকাররম জাহ বহুবিলিয়নিয়ার” বলা হতো, তিনি তখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
এই সময় তাঁর ব্যক্তিজীবনেও অস্থিরতা আসে। একাধিক বিবাহ, বিচ্ছেদ এবং পারিবারিক দূরত্ব তাঁকে আরও একা করে তোলে। তাঁর স্ত্রীদের কেউ কেউ তুরস্কে, কেউ অস্ট্রেলিয়ায়, কেউ ভারতে থেকেছেন, কিন্তু কোথাও তিনি শান্তি খুঁজে পাননি।
অবশেষে আশির দশকে তিনি চলে যান তুরস্কে, তাঁর মাতামহের দেশ। সেখানে তিনি নতুন করে জীবন সাজানোর চেষ্টা করেন। ইস্তাম্বুলের নিসানতাসি এলাকায় ছোট একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। এক সময়কার রাজা তখন সাধারণ নাগরিক, নিজের পরিচয় প্রকাশ করতেন না। তাঁকে চিনত স্থানীয়রা একজন সংযত, নীরব ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে—যিনি অতীতের কথা খুব একটা বলতেন না, কিন্তু যাঁর চোখে লুকিয়ে থাকত হারানো রাজ্যের স্মৃতি।
তুরস্কে থাকাকালীন তিনি মাঝে মাঝে হায়দরাবাদে ফিরতেন, রাজপ্রাসাদের সংস্কার ও সম্পত্তি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতেন। কিন্তু প্রতিবারই ফিরে যেতেন নীরবে, যেন ইতিহাসের এক প্রেতাত্মা নিজ অতীতের ধ্বংসস্তূপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তাঁর জীবনের এই নির্বাসন ছিল এক আত্মসমর্পণের গল্প। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, রাজকীয় গৌরব, হীরা, সোনা, প্রাসাদ, এসবের কোনো স্থায়ী মূল্য নেই। জীবনের সত্যিকারের মূল্য হয়তো নিহিত সাধারণতার ভেতরে, যে সাধারণতা তিনি রাজত্ব হারিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক প্রান্তর হোক বা ইস্তাম্বুলের ব্যস্ত রাস্তা, সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন একা, এক রাজা যিনি নিজের রাজ্য হারিয়ে খুঁজেছেন নিজের অস্তিত্বের মানে।
তাঁর জীবনের এই পর্ব ইতিহাসে এক গভীর প্রতীক হয়ে আছে, এক সম্রাটের পতন নয়, বরং এক মানুষের পুনর্জন্মের চেষ্টার গল্প।










