Home Second Lead শিশুর দেহে নীরব বিষ: গর্ভবতী মা, শিশু ও কিশোরদের ওপর প্রভাব

শিশুর দেহে নীরব বিষ: গর্ভবতী মা, শিশু ও কিশোরদের ওপর প্রভাব

বিষের ছায়ায় কৃষি ও জনস্বাস্থ্য : পর্ব-৫

তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: বাংলাদেশে প্রতিদিনের খাবারের বেশিরভাগই আসে কৃষিজমি থেকে, যেখানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় রাসায়নিক কীটনাশক ও সার। এই রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের নয়, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ফেলে শিশু, কিশোর এবং গর্ভবতী মায়েদের। কারণ তাদের শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকাশ এখনো পূর্ণতা পায়নি, ফলে সামান্য বিষক্রিয়াও দীর্ঘমেয়াদে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভাবস্থায় মা যদি কীটনাশকের সংস্পর্শে আসেন, তা সরাসরি প্লাসেন্টার মাধ্যমে ভ্রূণের শরীরে পৌঁছাতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু রাসায়নিকের প্রভাব শিশুর মস্তিষ্কের প্রাথমিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এর ফলে জন্মের পর শিশুর বুদ্ধিবিকাশ, মনোযোগ ক্ষমতা বা আচরণগত স্বাভাবিকতায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটি বা অকাল প্রসবের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

গ্রামাঞ্চলে এই ঝুঁকি আরও প্রবল। অনেক গর্ভবতী নারী মাঠে কৃষিকাজে সাহায্য করেন, আবার কেউ কেউ স্প্রে করা জমির কাছাকাছি থাকেন। স্প্রে হওয়ার পর কিছুক্ষণ বাতাসে ভেসে থাকা রাসায়নিক কণা সহজেই শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে। বাড়ির উঠোনে শুকানো ধান বা সবজিতেও লেগে থাকে রাসায়নিকের চিহ্ন, যা অনিচ্ছাকৃতভাবেই গর্ভবতী নারীর খাদ্যতালিকায় ঢুকে পড়ে।

শিশুরাও একইভাবে ঝুঁকির মধ্যে। স্কুল থেকে ফিরে তারা প্রায়ই মাঠে খেলতে যায়, যেখানে স্প্রে করা হয়েছে কয়েক ঘণ্টা আগে। শিশুরা গাছে ওঠা, মাটিতে বসে খেলা বা পানি ছিটানোর মতো কাজের সময় হাত-মুখে রাসায়নিক চলে যেতে পারে। তাদের শরীর এসব বিষাক্ত উপাদান ভেঙে ফেলার ক্ষমতা কম, ফলে প্রভাবও বেশি হয়। এতে শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, ত্বকের সমস্যা বা হরমোনজনিত অসামঞ্জস্য দেখা দিতে পারে।

কিশোর ও টিনএজারদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি কম নয়। তাদের অনেকেই পরিবারের কৃষিকাজে সহায়তা করতে গিয়ে স্প্রে মেশিন টেনে নিয়ে যায় বা জমিতে কাজ করে। সঠিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া এসব কাজে অংশ নেওয়ায় তারা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকির শিকার হতে পারেন। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কৈশোরে নিয়মিত রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে ভবিষ্যতে প্রজননক্ষমতা ও হরমোন ভারসাম্য ব্যাহত হতে পারে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, শিশু বা কিশোরদের মধ্যে কিছু উপসর্গ যেমন বারবার মাথাব্যথা, মনোযোগ কমে যাওয়া, অতিরিক্ত বিরক্তি, চর্মরোগ বা হজমের সমস্যা—এসব অনেক সময় রাসায়নিক বিষক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে, যদিও পরিবারগুলো তা বুঝতে পারেন না। কারণ এসব উপসর্গ সাধারণ অসুস্থতার সঙ্গে মিলে যায়।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্প্রে করা জমির পাশে শিশুদের খেলা নিষিদ্ধ করা, গর্ভবতী নারীদের মাঠের কাছাকাছি কাজ না করার পরামর্শ দেওয়া এবং পরিবারের সবাইকে বিষাক্ত রাসায়নিকের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি, স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি দপ্তরের উচিত গ্রামে গ্রামে প্রচারণা চালানো, যাতে পরিবারগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাতেই ঝুঁকি কমাতে পারে।

কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে না আনলে শিশুর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্বাস্থ্যঝুঁকির ভার বইতে থাকবে অজান্তেই। এই নীরব বিষের প্রভাব একবার শুরু হলে তার ক্ষতি থামাতে অনেক সময় লেগে যায়।

লাইক দিন 👍, শেয়ার করুন 🔁, এবং মন্তব্যে জানান আপনার মতামত!