বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হৃদয়বিদারক এক ঘটনা ঘটেছে। প্রেমে প্রতারিত হয়ে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে হলের ছাদ থেকে লাফ দিয়েছেন এক শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার (২৫ জুন) রাত ১১টা ২০ মিনিটে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের চারতলার ছাদ থেকে নিচে ঝাঁপ দেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাফ দেওয়ার আগে তিনি উচ্চস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ বলেন।
অত্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার দুই পা ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে।
ছাত্রটির নাম এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করা হলেও, তার ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। আত্মহত্যার আগে তার ফেসবুক টাইমলাইনে একাধিক পোস্ট দেখা যায়, যেখানে সে তার প্রেমিকা ‘লিসা’কে উদ্দেশ করে আবেগঘন ও ক্ষোভমিশ্রিত বার্তা লিখেছে।
এক পোস্টে সে লেখে, ‘ভালোবাসি লিসা… সব জায়গায় সেইম ইফোর্ট সেইম ডায়ালগ কীভাবে পারো লিসা? মানুষ এতটা সাইকো কীভাবে হয়?’ আরেকটি পোস্টে লিখেছে, ‘আমার খুব ইচ্ছা, আমার কবর হবে মসজিদের পাশে, যেখান থেকে আমি ইমামের তেলাওয়াত শুনতে পারবো।’ সেই সঙ্গে মায়ের খোঁজ নেওয়ার জন্যও অনুরোধ রেখেছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক ছাত্র বলেন, “আমি যখন তিনতলায় উঠছিলাম, তখন হঠাৎ একজনকে ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে শুনি, পরক্ষণেই বিকট শব্দ হয়। দৌড়ে গিয়ে দেখি ছেলেটি নিচে পড়ে আছে, তার পা দুটো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।”
অভিযোগ রয়েছে, সম্পর্কের ভাঙন ও প্রতারণা নিয়ে সে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিল। পাশাপাশি তার আর্থিক সংকট এবং পারিবারিক সমস্যাও ছিল। তার এক বন্ধু জানান, “সে খুব সরল ছেলে ছিল, কুরআনের হাফেজ এবং নিয়মিত নামাজ পড়ত। তবে আর্থিক সমস্যায় ভুগছিল।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, “ঘটনার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয় এবং দ্রুত তাকে মেডিকেলে নেওয়া হয়। বিস্তারিত তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”
হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক মো. আরিফুল ইসলাম জানান, “ঘটনার সময় আমি বাইরে ছিলাম। পরে হলে গিয়ে জানতে পারি সে ফার্স্ট ব্লকের চারতলা থেকে লাফ দিয়েছিল। একটি পা ভেঙে গেছে নিশ্চিত।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, ঘটনাটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীর মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ইতিপূর্বেও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বা আত্মহত্যাচেষ্টার বেশ কয়েকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, প্রেমঘটিত সম্পর্ক, পরিবারিক ও আর্থিক সংকটের প্রতিফলন বলে মনে করা হয়। নিচে এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
১. জানুয়ারি ২০২৪: ছাত্রীনিবাসে গলায় ফাঁস
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী সাদিয়া ইসলাম তমা নিজ কক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ছাত্রী হলে থাকতেন। ধারণা করা হয়, মানসিক চাপে ভুগছিলেন তিনি। তার রুমমেটের সঙ্গে কিছু সময় আগে ঝগড়ার কথাও উঠে আসে তদন্তে।
২. সেপ্টেম্বর ২০২২: প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা
মতিহার হলে থাকতেন ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মাহবুবুর রহমান। প্রেমিকা সম্পর্ক ছিন্ন করার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এক সকালে তার লাশ মেলে তার কক্ষে, গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায়। তিনি একটি সুইসাইড নোটও রেখে গিয়েছিলেন, যেখানে প্রেমঘটিত যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করেন।
৩. নভেম্বর ২০২১: পরীক্ষা নিয়ে হতাশায় আত্মহত্যা
রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী, তানভীর আহমেদ, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলের কারণে গভীর হতাশায় ছিলেন। তার রুমমেট জানান, তানভীর রাতে ঘুমানোর আগে বিষণ্নতার কথা বলেছিলেন। পরদিন সকালে তার নিথর দেহ পাওয়া যায়।
৪. আগস্ট ২০২০: আর্থিক সংকটে আত্মহননের চেষ্টা
করোনাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও একজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে এসে তার বন্ধুর কক্ষে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তিনি চরম আর্থিক সংকটে ছিলেন বলে পরে জানা যায়। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে মানসিক সহায়তা দেওয়া হয়।
৫. জুলাই ২০১৮: ল্যাবরেটরিতে বিষপানে আত্মহত্যা
প্রাণরসায়ন বিভাগের এক ছাত্র, নাজমুল হোসেন, ল্যাব থেকে সংগ্রহ করা রাসায়নিক পদার্থ পান করে আত্মহত্যা করেন। তার ডায়েরিতে মায়ের প্রতি চিঠি পাওয়া যায়, যেখানে তিনি জীবনের প্রতি হতাশা প্রকাশ করেছিলেন।
এসব ঘটনার প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রেই দেখা গেছে—যথাযথ কাউন্সেলিং, মানসিক চাপ মোকাবিলায় সহায়তা বা সুশৃঙ্খল শিক্ষার্থী সহায়তা ব্যবস্থা না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা একা হয়ে পড়ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ নিলেও, বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকায় এ ধরনের ট্র্যাজেডি বারবার ঘটছে বলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক মহলে মত প্রকাশ পায়।