কামরূল ইসলাম, ঢাকা: দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার মূল স্তম্ভ বনভূমি। অথচ বন বিভাগের বিশাল পরিমাণ জমি এখন অস্তিত্ব সংকটে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে বন বিভাগের প্রায় ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর জমি বর্তমানে প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। শিল্পায়ন, আবাসন প্রকল্প এবং পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার নামে বছরের পর বছর ধরে চলছে এই দখলদারিত্ব। জমি উদ্ধারে বন বিভাগের আইনি লড়াই ও উচ্ছেদ অভিযান চললেও, বেদখল হওয়া জমির তুলনায় সাফল্যের হার অত্যন্ত নগণ্য।
দখলদারিত্বের পরিসংখ্যান ও ধরণ
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং বিগত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ তথ্য বলছে, বর্তমানে সারা দেশে বনভূমি জবরদখলকারীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ জন। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ের দখলদার যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বড় বড় শিল্প গ্রুপ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। মূলত ভুয়া দলিল, দীর্ঘমেয়াদী লিজের নামে প্রতারণা এবং স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে এসব জমি গ্রাস করা হয়েছে।
** হটস্পট: কক্সবাজার ও শিল্পাঞ্চল**
বনভূমি দখলের চিত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা কক্সবাজার জেলায়। পর্যটন নগরী ও রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের কারণে এখানে প্রায় ৫৯ হাজার ৪৭১ একর বনভূমি বেহাত হয়েছে।
অন্যদিকে, বাণিজ্যিক কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো। বিশেষ করে গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে শিল্পকারখানা এবং রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা বনের জমি গিলে খাচ্ছে।
টাঙ্গাইল: প্রায় ৫২ হাজার একর জমি বেদখলে।
গাজীপুর: রাজধানীর উপকণ্ঠ হওয়ায় এখানে জমির দাম আকাশচুম্বী। ফলে প্রায় ২৫ হাজার একর বনভূমি দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য টেক্সটাইল, ডাইং ফ্যাক্টরি ও বিলাসবহুল রিসোর্ট।
ময়মনসিংহ: এখানে বেদখলে রয়েছে প্রায় ২৪ হাজার একর জমি।
অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর প্রভাব
বনভূমি বেদখল হওয়ার ফলে কেবল পরিবেশগত বিপর্যয়ই ঘটছে না, রাষ্ট্র হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ও সম্পদ। সংরক্ষিত (Reserved) ও রক্ষিত (Protected) বনাঞ্চল উজাড় করে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিজনেস অ্যানালিস্টরা বলছেন, বনের জমি দখল করে গড়ে ওঠা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করায় আন্তর্জাতিক বাজারেও ভাবমূর্তি সংকটে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে।
উদ্ধারে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
বন বিভাগ বলছে, জমি উদ্ধারে প্রধান বাধা আইনি জটিলতা। উচ্ছেদ নোটিশ দিলেই দখলদাররা উচ্চ আদালতে রিট করেন। বর্তমানে হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন থাকায় আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এছাড়া জনবল সংকট এবং স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের বাধার মুখে অনেক সময় উচ্ছেদ অভিযান ব্যর্থ হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দখলদারদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তা জনসম্মুখে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলা হলেও, মাঠ পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশবিদদের মতে, কেবল উচ্ছেদ অভিযান নয়, বনের জমি রক্ষায় ডিজিটাল ল্যান্ড জোন ম্যাপ তৈরি এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আর্থিক জরিমানার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।









