কলকাতার বাবু কালচার
কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: কলকাতার বাবু সংস্কৃতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বিদেশি শখ। ব্রিটিশ শাসনামলে ইউরোপীয় প্রভাব কলকাতায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধনী জমিদার ও বাবুরা সেই প্রভাবকে শুধু গ্রহণ করেননি, বরং সেটিকে নিজেদের আভিজাত্য প্রদর্শনের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছিলেন। ইংরেজ সমাজে নিজেদের উচ্চ আসন প্রমাণ করতে বাবুরা নিত্য নতুন বিদেশি জিনিস আমদানি করতেন এবং প্রতিযোগিতা করে সেগুলো ব্যবহার করতেন।
বাবুদের পোশাকে তখন স্পষ্টভাবে দেখা যেত বিলিতি ছোঁয়া। মসলিন আর সিল্কের পাশাপাশি তারা আমদানি করতেন ইউরোপীয় স্যুট, টুপি, কোট, এমনকি বিশেষ ধরনের হাতমোজা ও জুতা। কেউ কেউ গরমে অস্বস্তি সত্ত্বেও শুধু আভিজাত্যের জন্য বিলিতি কোট পরে শহরে বের হতেন। এই পোশাকের সঙ্গে যুক্ত হতো বিদেশি সুগন্ধি ও বিলাসবহুল প্রসাধনী, যা বাবুদের চেহারাকে আরও জাঁকজমকপূর্ণ করে তুলত।
শুধু পোশাক নয়, বাড়ির সাজসজ্জাতেও বাবুরা ছিল অনন্য। তাদের দালানকোঠায় আনা হতো ইতালিয়ান কাঠের আসবাব, ফরাসি আয়না, ইউরোপীয় ঝাড়বাতি, এমনকি ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা ডাইনিং সেট। এইসব সামগ্রী শহরের অন্যদের কাছে এক ধরনের বিস্ময় সৃষ্টি করত। অতিথিরা বাড়িতে প্রবেশ করলেই যেন ইউরোপের আভাস পেতেন। বাবুরা গর্বভরে সেই বিদেশি সামগ্রী প্রদর্শন করতেন এবং অন্য বাবুরা তার চেয়ে দামী কিছু আনার চেষ্টা করতেন।
বিলাসিতার এই প্রতিযোগিতা খাদ্যাভ্যাসেও প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। বাবুরা আমদানি করতেন বিলিতি মদ, ফরাসি ওয়াইন, কখনো কখনো লন্ডন থেকে আসা বিশেষ কেক বা পনির। অতিথি আপ্যায়নের আসরে বিদেশি খাবার পরিবেশন করা ছিল বিশেষ মর্যাদার ব্যাপার। একজন বাবুর আসরে যদি ইংল্যান্ড থেকে আনা ওয়াইন থাকত, তবে অন্যজন পরের আসরে সেটার চেয়ে দামী বোতল পরিবেশন করে নিজের আসরকে সবার উপরে নিয়ে যেতে চাইতেন।
বিদেশি শখ বাবুদের জীবনে কেবল বিলাসিতা নয়, একধরনের সামাজিক পরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ইংরেজদের মতো পোশাক, তাদের মতো আচরণ, তাদের খাবার খাওয়া—সবকিছুই বাবুর কাছে ছিল আধুনিকতার প্রকাশ। এভাবে নিজেদের ব্রিটিশ সংস্কৃতির কাছাকাছি আনার চেষ্টা করে তারা সমাজে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করতে চাইতেন।
কিন্তু এর ফলাফল সবসময় ইতিবাচক হয়নি। অঢেল অর্থ ব্যয় করে বিদেশি জিনিস আমদানি করতে গিয়ে বাবুরা অনেক সময় আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। শুধু শখ মেটানোর জন্যই অনেকে তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। ফলে আভিজাত্যের বাহারি রূপ টিকলেও বাস্তবে তা হয়ে ওঠে ক্ষণস্থায়ী। ইতিহাসে দেখা যায়, এই বিদেশি শখের পেছনে অপচয় বাবু সংস্কৃতিকে আরও বেশি ক্ষণস্থায়ী করে তুলেছিল।
আজ কলকাতার কিছু পুরোনো বাড়িতে হয়তো তখনকার কিছু বিদেশি আসবাব বা ঝাড়বাতির চিহ্ন টিকে আছে। সেগুলো এখন কেবল অতীতের সাক্ষী। বাবুদের সেই বিদেশি শখ তখন তাদের সমাজে মর্যাদা এনে দিয়েছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পরিণত হয়েছিল পতনের গল্পে। বিলিতি পোশাক আর দামি আসবাবের ঝলকানি আজ ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে কেবল এক ধরনের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে।