যে রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি
কামরুল ইসলাম
সাংবাদিকতা জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে, যা সারা জীবন মনের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। সংবাদপত্রের পাতায় হাজারো রিপোর্ট ছাপা হয়, নাম হয়, যশ হয়। কিন্তু পাঠকের অগোচরেই এমন কিছু রিপোর্ট হারিয়ে যায়, যা হয়তো কাঁপিয়ে দিতে পারত প্রশাসনের ভিত্তি। আজ বলব ১৯৮৪ সালের এমনই এক হারিয়ে যাওয়া রিপোর্টের গল্প।
আমি তখন ‘দৈনিক সংবাদ’-এর স্টাফ রিপোর্টার। তখন সরকারের একটি বিশেষ কর্মসূচি চলছে—সহায়-সম্বলহীন, ভিটেমাটি হারা মানুষদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করা হবে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সারা দেশ থেকে অসহায় মানুষদের প্রথমে এনে রাখা হতো চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে অবস্থিত ‘হাজি ক্যাম্পে’। সেখান থেকেই পরে তাদের পাহাড়ে পাঠানো হতো।
খবর পেলাম, হাজি ক্যাম্পের ভেতরের পরিস্থিতি ভয়াবহ। সেখানে তদারকির দায়িত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট অত্যন্ত বদমেজাজি এবং নিষ্ঠুর প্রকৃতির। পুনর্বাসনের জন্য আসা অসহায় নারী-পুরুষদের ওপর তিনি অকারণে চড়াও হন। কথায় কথায় বেত্রাঘাত করেন, চলে বেদম প্রহার। অভিযোগটা ছিল গুরুতর, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন!
সিদ্ধান্ত নিলাম সরেজমিনে তদন্ত করব। সঙ্গে নিলাম ‘সংবাদ’-এর তুখোড় ফটোগ্রাফার লুৎফুর রহমান বীনুকে ( প্রয়াত) । চট্টগ্রাম পৌঁছে যোগাযোগ করলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, উত্তর কাট্টলীর স্থানীয় বাসিন্দা মো. সালাহউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে। স্থানীয় ও চটপটে হওয়ায় তাকে গাইড হিসেবে সঙ্গে নিলাম।
আমরা তিনজন হাজি ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকলাম। খুব বেশি সময় লাগল না অভিযোগের সত্যতা পেতে। ক্যাম্পের পরিবেশ থমথমে। একটু এগোতেই চোখে পড়ল লোমহর্ষক দৃশ্য। বহু নারী-পুরুষের পিঠে, হাতে-পায়ে বেত্রাঘাতের দগদগে ঘা। নির্যাতনের চিহ্নগুলো তখনও তাজা।
বীনু দেরি করল না। ক্যামেরা বের করে একের পর এক ছবি তুলতে শুরু করল। ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। আর এটাই হলো কাল। ক্যামেরার সাটার আর আমাদের তৎপরতা দেখে ক্যাম্পের ভেতরের লোকজন বুঝে গেল—সাংবাদিক ঢুকেছে! মুহূর্তের মধ্যে প্রশাসনের কিছু পোষা চামচা আর দালাল আমাদের ঘিরে ফেলল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল।
ভাগ্যিস সালাহউদ্দিন সাথে ছিল। স্থানীয় হওয়ায় ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ তাকে চিনে ফেলে। সালাহউদ্দিন মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি আঁচ করে আমাদের পরিচয় দিয়ে দিল, কিন্তু একইসাথে বুঝল এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা নিরাপদ নয়। ও প্রায় বিদ্যুৎগতিতে আমাদের ছোঁ মেরে ওদের জটলা থেকে বের করে নিয়ে এল। আমরা দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়লাম। বলা চলে, সে যাত্রায় বড়সড় মারধরের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছিলাম।
ঢাকায় ফেরার পথে উত্তেজনায় কাঁপছি। এটা নিছক কোনো নিউজ নয়, এটা একটা ‘বোমা’। সরকারের পুনর্বাসন কর্মসূচির আড়ালে এমন পৈশাচিকতা চলছে তা প্রকাশ পেলে তোলপাড় শুরু হবে। ঢাকায় পৌঁছেই রিপোর্ট লিখতে বসলাম। বীনু ডার্করুম থেকে ছবিগুলো ওয়াশ করে আনল। ছবিগুলো কথা বলছে-নিরীহ মানুষের চামড়ায় ফুটে ওঠা নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র।
পরদিন লিড নিউজ হবে, এটাই প্রত্যাশা। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বার্তা সম্পাদক এলেন। তিনি রিপোর্ট দেখে উত্তেজিত। কিন্তু ঠিক তখনই একটা ফোন এল। বার্তা সম্পাদক কথা বললেন, তারপর মুখটা গম্ভীর করে জানালেন, সম্পাদক সাহেব (প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, চা শিল্পপতি আহমদুল কবির) রিপোর্টটা আটকে রাখতে বলেছেন। নির্দেশ, পরদিন বেলা ১২টায় রিপোর্ট আর ছবি নিয়ে তাঁর সঙ্গে বসতে হবে।
আমি হতভম্ব। কেন? এত বড় নিউজ! রাতে ঘুমাতে পারলাম না। পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে বার্তা সম্পাদকসহ সম্পাদক সাহেবের রুমে গেলাম। আহমদুল কবির তখনো পুরো ঘটনা জানতেন না। তিনি শুধু জানতেন, এই রিপোর্ট ছাপা হলে সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম পুনর্বাসন কর্মসূচি বড় ধরনের বাধার মুখে পড়বে।
আমরা তাঁকে বিস্তারিত জানালাম। বীনুর তোলা ছবিগুলো দেখালাম। নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা শুনে তিনিও বিচলিত হলেন। কিন্তু শেষমেশ জানালেন আসল কারণ। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব তাঁকে সরাসরি ফোন করে অনুরোধ করেছেন রিপোর্টটা যেন না ছাপা হয়। তাঁদের যুক্তি ছিল। এই রিপোর্ট প্রকাশ পেলে মানুষ ভয়ে আর পার্বত্য চট্টগ্রামে যেতে চাইবে না, ভেস্তে যাবে সরকারের পুরো পরিকল্পনা।
রিপোর্ট আর ছবিগুলো সম্পাদকের টেবিলেই রয়ে গেল। আর কোনোদিন সেগুলো ‘সংবাদ’-এর পাতায় আলোর মুখ দেখল না। একজন রিপোর্টার হিসেবে সেই মুহূর্তের কষ্টটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। চোখের সামনে এত বড় অন্যায়, অথচ আমি নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য হলাম।
তবে এই গল্পের একটা ছোট স্বস্তির জায়গা আছে। রিপোর্টটি ছাপা না হলেও, আমাদের সেই অভিযানের খবর প্রশাসনের উপরমহলে পৌঁছেছিল। সেই বদমেজাজি ম্যাজিস্ট্রেটকে তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে বদলি করা হয়েছিল। হয়তো এটুকুই ছিল আমাদের সেই ‘অপ্রকাশিত’ রিপোর্টের একমাত্র সার্থকতা।
আজ ৪১ বছর পর, সেই ঘটনা মনে পড়লে ভাবি, সাংবাদিকতা আসলে শুধু যা ছাপা হয় তা নয়, যা ছাপা হতে দেওয়া হয় না, সেটাও ইতিহাসের অংশ।










