Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য শতবর্ষী বৎসলার শেষ বিদায়: জঙ্গলের ‘দাই মা’র গল্প

শতবর্ষী বৎসলার শেষ বিদায়: জঙ্গলের ‘দাই মা’র গল্প

বৎসলা। ছবি সংগৃহীত

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: পান্নার জঙ্গল আজ নিঃশব্দ। নেই সেই নরম পায়ের চলাফেরা, নেই বাচ্চাদের আশ্রয় দিতে ছুটে যাওয়া এক মাতৃস্নেহময় উপস্থিতি। পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত হাতি,  ভারতের মধ্যপ্রদেশের পান্না টাইগার রিজার্ভের বৎসলা আর নেই। মঙ্গলবার দুপুরে হিনাউটা এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে শতায়ু এই মৃদুভাষী প্রাণী। বয়স শত পেরিয়েছিল বহু আগেই। শেষ ক’দিন ধরে অসুস্থ ছিল। কিন্তু প্রাণের দীপ্তি এতটুকু মলিন হয়নি তার।

জীবনের শুরু হয়েছিল বহু দূরের এক অরণ্যে—কেরলের নীলাম্বুরে। সেখান থেকে দীর্ঘ পথচলার পর ১৯৭১ সালে হোশঙ্গাবাদের বোড়ি স্যাংচুয়ারিতে এসে থেমেছিল কিছুদিন। তখনই তার বয়স ছিল প্রায় পঞ্চাশ। পরে, ১৯৯৩ সালে তাকে আনা হয় পান্না টাইগার রিজার্ভে। সেখানেই দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময়ের বাস, আর এখানেই গড়ে তোলে নিজের একটি পরিবার। শুধু নিজের বাচ্চা নয়, অন্য হাতিদের সন্তানদের দিকেও ছিল তার অবারিত স্নেহ। মা নয়, যেন জঙ্গলের ‘দাই মা’।

চোখে ছানি, পায়ে বয়সের ভার—তবুও থেমে থাকেনি বৎসলা। হাতির বাচ্চা জন্ম নিলেই ডাক পড়ত তার। দৌড়ে গিয়ে আগলে রাখত, আদর করত, বিপদে ছুটে যেত আগে-পিছে না ভেবে। ঘুরে ফিরে সবার সঙ্গে থাকত, মাহুতদের ইশারা বুঝত, কাজেও সহযোগিতা করত—যেন এই জীবনটাই ছিল তার আনন্দের উৎস।

তবে জীবনের সব মুহূর্ত আনন্দময় ছিল না। রাম বাহাদুর নামে এক পুরুষ হাতির আক্রমণে ২০০৩ সালে তার শরীরে পড়েছিল ২০০টির বেশি সেলাই। ২০০৮ সালেও আরও একবার একই হাতির আক্রমণের শিকার হয়। এক মাহুতের মৃত্যুও হয়েছিল সেই ঘটনায়। তারপর বৎসলাকে রাখা হয় আলাদা করে। কিন্তু এত কষ্ট-আঘাতের পরও পাল্টা প্রতিশোধ নেয়নি কখনও। তার চোখের দৃষ্টি ছিল শুধু স্নেহ আর শান্তির প্রতীক।

বৎসলার মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন ক্যাম্পের রেঞ্জার আরপি অর্গারিয়া, বন সংরক্ষক অঞ্জনা সুচিতা তিরকি, উপ-পরিচালক মোহিত সুধসহ সকল বনকর্মী। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিরকি বলেন, “বৎসলা এই ক্যাম্পকে নিজের ঘর বানিয়েছিল। তাই এখানেই তাকে সম্মানের সঙ্গে দাহ করা হয়েছে।”

গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বৎসলার নাম ওঠেনি। নেই জন্ম সংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র। কিন্তু যারা বৎসলাকে দেখেছেন, কাছ থেকে চিনেছেন, জানেন—সেই নাম অনেক উঁচুতে, বহু হৃদয়ের পাতায় অমর হয়ে থাকবে। বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ রাজেশ দীক্ষিত বলেন, “ওর মতো হাতি খুব কমই জন্মায়। মাতৃত্ব, সহনশীলতা আর ভালোবাসার জীবন্ত প্রতীক ছিল বৎসলা।”

জঙ্গলের প্রতিটি বৃক্ষ, প্রতিটি পথ আজ যেন নিঃসঙ্গ হয়ে উঠেছে। বৎসলার জায়গা হয়তো আর কেউ নিতে পারবে না। পান্নার বনে এখনও তার নরম চলার শব্দ যেন প্রতিধ্বনিত হয়, বাতাসে ভেসে আসে সেই করুণ অথচ শান্ত মুখের স্মৃতি।