Home আগরতলা ভারতীয় রুপির টালমাটাল যাত্রা: দুর্বল ডলারের মাঝেও স্থিতি ফেরাতে লড়ছে

ভারতীয় রুপির টালমাটাল যাত্রা: দুর্বল ডলারের মাঝেও স্থিতি ফেরাতে লড়ছে

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: ২০২৫ সালজুড়ে দীর্ঘ ও অস্থির পথ পাড়ি দিয়েছে ভারতীয় রুপি। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মার্কিন নীতির অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের চাপ মিলিয়ে রুপি যেন এক অদৃশ্য ঝড়ের মধ্যে আটকে পড়েছে। ডলার বছরের শুরুতে দুর্বল অবস্থায় থাকলেও এখন এক মোড় ঘোরার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২৬ সালের মার্চ ও পরবর্তী অর্থবছর (২০২৬–২৭) নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে—রুপির গন্তব্য কোথায়?

বিশ্লেষকদের মতে, এটি কেবল মুদ্রাবাজারের গল্প নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীতিনির্ধারণের ওপর রাজনৈতিক প্রভাবের ইঙ্গিতও বহন করছে।

ডলার বাজারের মোড় ঘোরার ইঙ্গিত

রুপির গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য প্রথমেই নজর দিতে হয় মার্কিন ডলারের দিকে। উদীয়মান বাজারগুলোর মুদ্রা সাধারণত ডলারের গতির ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে ডলার এক সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে।

একটি সম্ভাব্য চিত্র হলো—ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমানোর চক্রে প্রবেশ করবে এবং অর্থনীতি মন্দা এড়াতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ডলার দুর্বল হবে, ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।

অন্য চিত্রটি হলো—যদি ফেড প্রত্যাশার তুলনায় দ্রুত সুদ কমিয়ে ফেলে বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে স্বাধীনতা হারায়, তবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে এবং বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ডলার ধীরে ধীরে দুর্বল হওয়ার দিকেই এগোবে। এতে তাত্ত্বিকভাবে রুপির মতো উদীয়মান বাজারের মুদ্রাগুলোর জন্য ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা, কারণ এতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়, ডলার ঋণের চাপ কমে এবং রপ্তানি বাড়ে। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা ততটা সহজ নয়।

তবু রুপি চাপে কেন

ডলারের দুর্বলতার মধ্যেও ২০২৫ সালে রুপি তার মান ধরে রাখতে পারেনি। আগস্টের শেষ দিকে এটি ১ ডলারের বিপরীতে ৮৮ রুপির রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছায়। এতে বাজারে অনেকের মনে পড়ে যায় ২০১৩ সালের ‘টেপার ট্যানট্রাম’-এর কথা, যখন রুপি হঠাৎ করে ১৪ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছিল। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।

সাম্প্রতিক বৈদেশিক মুদ্রা অপশন ডেটা অনুযায়ী, বাজারে অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান নেই। মাত্র ৬.৪ শতাংশ ডলার কল অপশন বর্তমান মূল্যের চার শতাংশের বেশি উপরে নির্ধারিত, যেখানে ২০১৩ সালে তা ছিল ৫০ শতাংশেরও বেশি। তাছাড়া বাজারে রুপি পুনরুদ্ধারের পক্ষে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও দেখা যাচ্ছে।

রুপির ব্যবস্থাপনায় আরবিআইয়ের নতুন কৌশল

২০১৩ সালের তুলনায় এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) অনেক বেশি অভিজ্ঞ ও কৌশলগতভাবে প্রস্তুত। এবার তারা নির্দিষ্ট বিনিময় হার ধরে রাখতে তাড়াহুড়া করেনি। আগস্টে রুপি ৮৮ রুপির সীমা ছাড়ালেও আরবিআই হালকা হস্তক্ষেপেই সীমিত থেকেছে।

তথ্য বলছে, আগস্টে আরবিআই প্রায় ৩.৯ বিলিয়ন ডলার স্পট বাজারে বিক্রি করেছে, যা অতীতের তুলনায় খুবই সামান্য। অন্যদিকে মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে তারা প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ পুনর্গঠন করেছে। এতে তারা ভবিষ্যতে হস্তক্ষেপের জন্য যথেষ্ট আর্থিক সুরক্ষা তৈরি করতে পেরেছে।

এই নীতিগত পরিবর্তনের ফলে আরবিআই এখন বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিচ্ছে এবং প্রয়োজনবোধে কৌশলগত হস্তক্ষেপ করছে—যা রুপির স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক দিক বলে মনে করা হচ্ছে।

রুপিকে পিছিয়ে দিচ্ছে যেসব কারণ

তবে রুপির শক্তি ফেরাতে কিছু বড় বাধা রয়ে গেছে—

বাণিজ্যিক চাপ: যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ নতুন শুল্ক আরোপ করেছে, যার সঙ্গে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির কারণে আরও ২৫ শতাংশ জরিমানামূলক শুল্ক যুক্ত হয়েছে। এতে ভারতের বাণিজ্য ভারসাম্য নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।

বিনিয়োগ প্রত্যাহার: বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা (FPI) শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ১৬.৬ বিলিয়ন ডলার তুলে নিয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ কমেছে।

প্রয়োজনীয় সংস্কার ঘাটতি: প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় ভারতের বড় কোনো সংস্কার বা বিনিয়োগ প্রণোদনা নেই। যদিও ঋণ ও কর কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ কিছুটা আশাব্যঞ্জক।

আগামীর দিকনির্দেশ

রুপির ভবিষ্যৎ মূলত নির্ভর করবে তিনটি বিষয়ের ওপর—
১. যুক্তরাষ্ট্র কত দ্রুত ও কতটা সুদের হার কমায়,
২. বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা কতটা প্রশমিত হয়, এবং
৩. ভারত কতটা বিদেশি মূলধন আকর্ষণ করতে পারে।

বাজার বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মার্চ নাগাদ রুপি কিছুটা শক্তিশালী হয়ে ৮৬–৮৭ রুপির ঘরে আসতে পারে। ২০২৬–২৭ অর্থবছরে যদি বৈশ্বিক অস্থিরতা কমে এবং বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ে, তবে রুপি আরও শক্তিশালী হয়ে ৮৪–৮৫ রুপির পর্যায়ে যেতে পারে।

তবে শক্তিশালী ঘরোয়া প্রবৃদ্ধি, প্রযুক্তিনির্ভর রপ্তানি বা নতুন সংস্কার ত্বরান্বিত না হলে রুপি এখনও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে পড়ে থাকতে পারে।

ভারতীয় রুপি এখন কোনো বড় সংকটে নেই, তবে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণেও নয়। দুর্বল ডলার একদিকে কিছুটা সহায়তা দিচ্ছে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ অচলাবস্থা রুপির অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে আছে। আরবিআইয়ের কৌশলগত পদক্ষেপ রুপি বাজারে স্থিতি আনছে, কিন্তু মূল প্রশ্ন রয়ে গেছে—রুপি কি শুধু ভেসে থাকবে, নাকি নতুন গতি পাবে?