তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: বাংলাদেশের বাজারে প্রতিদিন যে সবজি, ফল বা চাল উঠে আসে, তার উৎস সেই অবারিত কৃষিজমি। তবে ফসলের রঙিন সতেজতা আর চাহিদার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নীরব বাস্তবতা, ক্ষতিকর কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ। মাঠে যে রাসায়নিক স্প্রে হয়, তার কতটা শেষ পর্যন্ত আমাদের প্লেটে পৌঁছে যাচ্ছে, সে নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক এবং সচেতন নাগরিকদের মধ্যে।
দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণার বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাজারে পাওয়া অনেক পণ্যেই অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি রাসায়নিক অবশিষ্ট থাকে। বিশেষ করে বেগুন, টমেটো, শসা, ফুলকপি, কলা ও আঙ্গুরের মতো ফসলে অবশিষ্টাংশের হার তুলনামূলক বেশি পাওয়া গেছে। দোকানের তাক বা ঠেলাগাড়িতে রাখা এসব ফসলের বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রায়ই বিভ্রান্ত করে ভোক্তাকে, কিন্তু ভেতরে থাকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নানা উপাদান।
কৃষকেরা সাধারণত পোকা দমন বা রোগ প্রতিরোধের জন্য যে স্প্রে ব্যবহার করেন, তা ফসলে দীর্ঘ সময় ধরে সক্রিয় থাকে। অনেক কীটনাশকের ‘কারেন্সি পিরিয়ড’ মানে স্প্রে থেকে পণ্য বাজারজাত করার পর্যন্ত প্রয়োজনীয় অপেক্ষার সময়, তা মানা হয় না। ফলস্বরূপ ফসল কাটার দিন বা তার আগেও রাসায়নিক স্প্রে করা হয়, যা সরাসরি খাদ্যচক্রে ঝুঁকি বাড়ায়।
হাটবাজারে নিয়মিত কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বাহ্যিক দিক দেখে পণ্য কিনলেও নিরাপদ খাদ্য নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে বহু মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ অর্গানিক বা নিরাপদ লেবেলযুক্ত কিছু পণ্য খুঁজে নেন, কিন্তু সেগুলোর দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। আবার এসব লেবেল বা সার্টিফিকেশন কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যায়।
খাদ্য পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাও বড় বাধা। দেশে খাদ্যপণ্য পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি নেই, আর যেগুলো আছে সেগুলোতে নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে রিপোর্ট প্রকাশ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এ কারণে বাজারে প্রচলিত অধিকাংশ কৃষিপণ্যের অবশিষ্টাংশ সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কোনো ধারণা পাওয়া কঠিন। ফলে ভোক্তার উপর ঝুঁকি থেকে যায় অনিবার্যভাবে।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, দীর্ঘমেয়াদে এসব রাসায়নিক শরীরে জমে লিভার, কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র ও হরমোনজনিত ব্যাধির ঝুঁকি বাড়ায়। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরও বিপজ্জনক, কারণ তাদের বিকাশমান শরীর রাসায়নিকের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। গর্ভবতী নারীদের জন্যও এ ঝুঁকি বহুগুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাধান একদিনে সম্ভব নয়। কৃষকের সচেতনতা বাড়াতে হবে, সঠিক বালাইনাশক ব্যবহারের নিয়ম শেখাতে হবে, আর বাজারে নকল ও অতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক বিক্রি বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে একটি শক্তিশালী মনিটরিং ও ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক, যাতে দ্রুত নমুনা পরীক্ষা ও ঝুঁকি মূল্যায়ন সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের খাদ্যচক্র এখন যেন এক অদৃশ্য সর্পিলের মধ্যে, মাঠে স্প্রে করা বিষ ধীরে ধীরে আমাদের প্রতিদিনের থালায় এসে ঠাঁই নিচ্ছে। এই প্রবণতা থামাতে না পারলে জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব আগামী দশকে ভয়াবহ রূপ নেবে।
পরবর্তী পর্বে থাকছে
কৃষকের শরীরে বিষ—দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি ও গ্রামীণ বাস্তবতা










