হুমকির মুখে সামুদ্রিক প্রতিবেশ
কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: বঙ্গোপসাগর একসময় ছিল মৎস্য সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডার। কিন্তু সেই ভাণ্ডারে এখন টান পড়েছে। গত সাত বছরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মাছের মজুত কমেছে আশঙ্কাজনক হারে—প্রায় ৭৮ শতাংশ। অবৈধ ও ধ্বংসাত্মক পন্থায় মাছ আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণহীন দূষণ বঙ্গোপসাগরকে ক্রমেই মাছের জন্য বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। এটি কেবল মৎস্য খাতের বিপর্যয় নয়, বরং পুরো সামুদ্রিক প্রতিবেশ বা ইকোসিস্টেমের জন্য এক ভয়াবহ অশনিসংকেত।
ভয়াবহ পরিসংখ্যান: কী বলছে জরিপ?
মৎস্য অধিদপ্তর ও গবেষণা জাহাজ ‘আরভি মীন সন্ধানী’-র সাম্প্রতিক জরিপ ও তথ্যের বিশ্লেষণে এক উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে সাগরে মাছের জৈবনিরাপত্তা বা বায়োমাস দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। ২০১৬-১৭ সালে সাগরে যে পরিমাণ মাছের মজুত ছিল, বর্তমানে তা ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। বিশেষ করে লাক্ষা, সার্ডিন, পোয়া ও বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ির প্রাপ্যতা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। একসময় জেলেরা সাগরে জাল ফেললেই প্রচুর মাছ পেতেন, এখন গভীর সমুদ্রে গিয়েও কাঙ্ক্ষিত মাছের দেখা মিলছে না।
বিপর্যয়ের প্রধান কারণ: অবৈধ ও অতিরিক্ত আহরণ
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাছের এই তীব্র সংকটের পেছনে মানুষের সৃষ্ট কারণই প্রধান।
১. ধ্বংসাত্মক জালের ব্যবহার: উপকূলীয় এলাকায় নিষিদ্ধ বেহুন্দি জাল, মশারি জাল এবং কারেন্ট জালের ব্যবহার কমেনি। এসব জালে আটকা পড়ছে মাছের পোনা ও ডিমওয়ালা মা মাছ। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, একবার বেহুন্দি জাল টানলে যে পরিমাণ পোনা নষ্ট হয়, তা ভবিষ্যতের হাজার হাজার টন মাছের সম্ভাবনাকে শেষ করে দেয়।
২. বটম ট্রলিং: গভীর সমুদ্রে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারগুলো ‘বটম ট্রলিং’ (Bottom Trawling) বা সাগরের তলদেশ ছেঁচে মাছ ধরছে। এতে মাছের আবাসস্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে। যদিও নির্দিষ্ট গভীরতার কমে ট্রলিং নিষিদ্ধ, কিন্তু নজরদারির অভাবে তা মানা হচ্ছে না।
৩. অতিরিক্ত আহরণ: বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মাছের প্রজননকাল ও আহরণ মাত্রা নির্ধারণ করা হলেও (Maximum Sustainable Yield), বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি মাছ ধরা হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের ধকল
অতিরিক্ত আহরণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি: সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বাড়ার কারণে অনেক প্রজাতির মাছ তাদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে অথবা মারা যাচ্ছে।
লবণাক্ততা ও অম্লতা: কার্বন নিঃসরণ বাড়ায় সাগরের পানি আম্লিক (Acidic) হয়ে যাচ্ছে, যা মাছের ডিম ও লার্ভা বিকাশে বাধা দিচ্ছে।
প্লাস্টিক ও রাসায়নিক দূষণ: কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন নদী দিয়ে আসা কারখানার বর্জ্য এবং প্লাস্টিক সাগরে মিশছে। এতে উপকূলীয় ‘নার্সারি গ্রাউন্ড’গুলো দূষিত হচ্ছে, যেখানে ছোট মাছ বড় হয়।
জেলেদের হাহাকার: ‘তেলের খরচই ওঠে না’
সরেজমিনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে জেলেদের হতাশা। পতেঙ্গার জেলে আবদুর রহিম বলেন, “আগে সাগরে গেলে ৫-৭ দিনে বোট ভর্তি মাছ নিয়ে ফিরতাম। এখন ১০-১২ দিন সাগরে থেকেও তেলের খরচ তোলাই দায়। মহাজনের ঋণ বাড়ছেই।”
ছোট ট্রলার মালিকরা বলছেন, বড় বড় ট্রলারগুলো সাগরের সব মাছ ছেঁচে নিয়ে যাচ্ছে, ফলে সাধারণ জেলেদের জালে আর মাছ ধরা পড়ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও করণীয়
সামুদ্রিক মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে আগামী এক দশকের মধ্যে বঙ্গোপসাগর মাছশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, “৭৮ শতাংশ মজুত কমে যাওয়া মানে আমরা বিপর্যয়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। শুধু ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিলেই হবে না। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে খুটাজাল ও বেহুন্দি জাল নির্মূল করা এবং সাগরের তলদেশ ছেঁচে মাছ ধরা ট্রলারগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।”
সাগর কেবল মাছের জোগান দেয় না, এটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে সাগরের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। দূষণ রোধ, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং বিজ্ঞানসম্মত আহরণ নিশ্চিত করা না গেলে, অদূর ভবিষ্যতে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ বাঙালির পাতে ওঠা দুষ্কর হয়ে পড়বে।










