বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, বগুড়া: বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও নাটোর জেলায় ১৯৫ কিলোমিটার রেলপথ যেন মৃত্যুর নীরব সীমানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২১ মাসে এই চার জেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১২০ জন—যারা ছিলেন পিতা-মাতার সন্তান, ভাই-বোন, বন্ধু এবং স্বপ্নের ভরসা। বগুড়া জেলায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ৫৪ জন।
বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো: সাজেদুর রহমান সাজু জানান, দুর্ঘটনার প্রধান কারণ অসচেতনতা। কেউ মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে লাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, কেউ ইয়ারফোনে গান শুনে নিরাপদ দূরত্ব না মেনে রেললাইন ধরে হাঁটছেন। কেউ তাড়াহুড়া করে লেভেলক্রসিং পার হচ্ছেন, কেউ চলন্ত ট্রেনের কাছে সেলফি তুলছেন বা টিকটক বানাচ্ছেন। কিছুর কারণ আত্মহত্যা, আবার কিছুর কারণ তুচ্ছ অসচেতনতা সব মিলিয়ে ট্রেনের নিচে পড়ে ঝরে যাচ্ছে অজস্র জীবন।
রেলওয়ে পুলিশ সান্তাহার থানার ওসি মো: হাবিবুর রহমান জানান, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ৯ মাসে ৫২ জন, আর ২০২৪ সালে ৬৮ জন মোট ১২০ জন মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে ৯৯ জন পুরুষ ও ২১ জন নারী। পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনার জন্য ১১৮টি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সান্তাহার, সোনাতলা, নাটোরের বাগাতিপাড়া ও মালনচি স্টেশন, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি ও বাগজানা—এই মোট ১৯৫ কিলোমিটার রেলপথ যেন শোকের রঙে রাঙা। মানুষ চলে যাচ্ছে চুপচাপ, কেউ তাদের বিদায়ের ঘণ্টা বেজে উঠছে না।
সর্বশেষ দুর্ঘটনা ঘটেছে চলতি বছরের ১ অক্টোবর। বগুড়ার আদমদীঘিতে এক ট্রেনের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধু—তৌফিক হোসেন (১৯) ও মারুফ হোসেন (১৯) নিহত। আহত আকাশ (১৯) হাসপাতালে ভর্তি। নিহত তৌফিক ও মারুফ ছিলেন গ্রামের সাধারণ ছেলে, স্বপ্ন ছিল শিক্ষার, ভবিষ্যতের, জীবনের নতুন সম্ভাবনার। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের অমন সচেতনতার অভাবে তাদের পরিবার আজ শূন্য হাতে।
স্থানীয়রা বলেন, “এই রেললাইন যেন মৃত্যুর আঙিনায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন দুঃখে ভরা পরিবারের চোখে চোখ পড়ছে।” প্রতিটি নাম, প্রতিটি মুখের পেছনে যে ক্ষত, যে শোক, তা সহজে বোঝা যায় না—তবুও ট্রেনের কণ্ঠহীন রাস্তায় প্রতিটি মৃত্যু বারবার মনে করিয়ে দেয় সতর্কতার প্রয়োজন।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ মানুষের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছেন—সচেতন হোন, রেলপথের ওপর দিয়ে অযত্নে হেঁটে যাওয়া জীবন বাজি রাখা চলবে না। তবে যখন পরিবার হারিয়েছে সন্তান, ভাই বা বন্ধু, তখন সচেতনতার আহ্বান যেন অচেনা শব্দ হয়ে বাজে। প্রতিটি জীবন যেন শুধু সংখ্যা নয়, বরং আমাদের মানবিক দায়িত্বের অনিবার্য পরীক্ষা।