Home সারাদেশ লালনের আখড়া: যেখানে মিলন ঘটে মানবতার সঙ্গে

লালনের আখড়া: যেখানে মিলন ঘটে মানবতার সঙ্গে

ছবি: এআই

লালনের দেশে: পর্ব ২

মোজাফফর রাহমান বাদল, কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় অবস্থিত লালন শাহের আখড়াবাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি একটি জীবন্ত দর্শন, একটি চলমান সাধনার কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ধ্বনিত হয় এক অন্য রকম সুর, যাকে অনেকে বলেন আত্মার ভাষা। আর এই আখড়াকেই মনে করা হয় মানবতার মহাসংগঠনের এক নিরব কেন্দ্র।

আখড়াবাড়ির মূল ভবনটি একটি একতলা চতুষ্কোণ ঘর, যার ঠিক মাঝখানে রয়েছে লালনের সমাধি। এটি ঘিরেই গড়ে উঠেছে সাধনপথের প্রাত্যহিক জীবন। প্রতিদিন এখানে লালন অনুসারীরা বসেন গান সাধনায়। কেউ গাইছেন একতারা বাজিয়ে, কেউ চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে আছেন। কারও মুখে উচ্চারিত হচ্ছে মানবধর্মের বাণী, আবার কেউ নিঃশব্দে বসে থেকে নিজের ভেতরের লালনকে অনুভব করছেন।

এই আখড়ার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে কোনো ধর্ম, জাত, লিঙ্গ কিংবা জাতপাতের বিভাজন নেই। কেউ যদি একটানা কয়েকদিন এখানে কাটান, তবে বুঝতে পারবেন মানুষের প্রকৃত পরিচয় কেবল মানুষ হওয়া। এখানে যারা থাকেন, তাদের বেশিরভাগই ফকির বা বাউল। তারা লালনের আদর্শ মেনে সাধনাভিত্তিক জীবন যাপন করেন। গাঁয়ের নানা প্রান্ত থেকে আসা এই মানুষগুলো মিলেমিশে এক হয়ে যান। ধর্মীয় পরিচয় এখানে গৌণ, মুখ্য হয়ে ওঠে অন্তর্জগতের পরিচয়।

আখড়ায় নিয়মিত চলে গান চর্চা। তবে এই গান কেবল সুরের জন্য নয়, এটি আত্মা শুদ্ধির এক উপায়। গানগুলোর কথা এমনভাবে রচিত, যা মানব জীবনের গভীর প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। এই গানের মাধ্যমেই সাধকরা নিজের মধ্যে ঈশ্বরের সন্ধান করেন। আখড়ার প্রতিটি কোণে কোণে যেন লালনের গানের প্রতিধ্বনি বাজে—কারো ধর্মের কাহিনী শুনে না রে মন দয়াল আমার নয়।

প্রতিবছর লালনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এখানে আয়োজন হয় স্মরণোৎসব। সে সময় আখড়ায় জমে যায় এক বিশাল মিলনমেলা। দেশি বিদেশি দর্শনার্থীরা আসে, কেউ গবেষণা করতে, কেউ গান শুনতে, কেউবা শুধু অনুভব করতে এই পবিত্র পরিবেশ। তবে উৎসব শেষ হওয়ার পরেও আখড়া থাকে তার আপন ছন্দে—নিঃশব্দ, গভীর ও ধ্যানমগ্ন।

তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন আখড়ায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। পর্যটক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রবাহ বেড়েছে। ফলে অনেক অনুসারী মনে করেন, লালনের নিরাভরণ সাধনার পথ কিছুটা হলেও আজ শঙ্কায় পড়েছে। তবুও যারা নিরবে এ পথ ধরে চলেছেন, তাদের কাছে এই আখড়াই শেষ ঠিকানা।

আখড়াবাড়ি শুধু একটি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নয়, এটি এক মানবতাবাদী চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। এখানেই মানুষ খোঁজে আপন পরিচয়, এখানে মিলেমিশে যায় সব বিভেদ, আর এখানেই লালনের দর্শন পরিণত হয় জীবন্ত বাস্তবতায়।

লালনের আখড়ার গভীরতা অনুভব করতে পরবর্তী পর্বে পড়ুন—লালনের গান ও দর্শনের অনুপম ব্যাখ্যা, শুধুমাত্র বিজনেসটুডে২৪.কম–এ।