Home স্বাস্থ্য অদৃশ্য রাসায়নিকেই বাড়ছে লিভার ফাইব্রোসিসের আশঙ্কা

অদৃশ্য রাসায়নিকেই বাড়ছে লিভার ফাইব্রোসিসের আশঙ্কা

বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা

হেলথ ডেস্ক: বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এমন একটি গৃহস্থালী ও ড্রাই ক্লিনিং উপাদান শনাক্ত করেছেন, যা মানুষের লিভারের জন্য গুরুতর এবং কখনো কখনো প্রাণঘাতী ক্ষতির কারণ হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার কেক মেডিসিনের গবেষণায় দেখা গেছে, টেট্রাক্লোরোইথিলিন (PCE) নামের এই রাসায়নিক পদার্থ লিভারের জন্য নতুন এক ঝুঁকি। এটি সাধারণত ড্রাই ক্লিনিং প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয় এবং ঘরে ব্যবহৃত অনেক পণ্য—যেমন গ্লু, দাগ তোলার দ্রব্য, স্টেইনলেস স্টিল পালিশ ইত্যাদিতেও পাওয়া যায়।

গবেষকরা ২০ বছর বা তার বেশি বয়সী ১,৬০০-রও বেশি মানুষের রক্ত পরীক্ষা করে দেখেন, প্রায় সাত শতাংশের রক্তে এই রাসায়নিকের উপস্থিতি রয়েছে। যাদের শরীরে সামান্য পরিমাণেও PCE পাওয়া গেছে, তাদের লিভার ফাইব্রোসিস হওয়ার ঝুঁকি তিন গুণ বেশি। এই ফাইব্রোসিস ধীরে ধীরে লিভার ক্যানসার, লিভার বিকলতা বা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে পারে।

গবেষক দলের প্রধান, কেক মেডিসিনের লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বিশেষজ্ঞ ড. ব্রায়ান পি লি জানান, “অনেক রোগী জানতে চান, ‘আমি তো মদ খাই না, আমার লিভার রোগ হলো কীভাবে?’—এর উত্তর হতে পারে PCE এক্সপোজার।”

PCE ড্রাই ক্লিনিং মেশিনের প্রধান সলভেন্ট। ফলে যারা এই শিল্পে কাজ করেন, তারা সারাদিন এই বাষ্পযুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চমাত্রার এক্সপোজারে থাকেন। এমনকি গ্রাহকরাও ঝুঁকিতে আছেন—ড্রাই ক্লিন করা কাপড় ঘরে আনলে তাতে লেগে থাকা রাসায়নিক কয়েক দিন পর্যন্ত কাপড় ও প্লাস্টিকের মোড়ক থেকে ধীরে ধীরে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যাদের শরীরে PCE-এর মাত্রা যত বেশি, তাদের লিভার ক্ষতির আশঙ্কাও তত বাড়ে। প্রতি এক ইউনিট PCE বৃদ্ধিতে লিভার স্ক্যারিং বা দাগ পড়ার ঝুঁকি পাঁচ গুণের বেশি বৃদ্ধি পায়। সামগ্রিকভাবে এটি লিভার রোগের প্রকোপ প্রায় ২৮ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।

আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা (IARC) ইতিমধ্যেই PCE-কে “সম্ভাব্য কার্সিনোজেন” বা ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর সঙ্গে ব্লাডার ক্যানসার, মাল্টিপল মায়েলোমা ও নন-হজকিন লিম্ফোমার সম্পর্কও পাওয়া গেছে।

গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন এক্সামিনেশন সার্ভে (NHANES) ২০১৭–২০২০ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। গবেষকরা আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের লিভারের শক্ততা পরিমাপ করে ফাইব্রোসিসের উপস্থিতি নির্ণয় করেছেন।

ফলাফল থেকে দেখা যায়, উচ্চ আয়ের মানুষদের মধ্যে PCE-এর উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। গবেষকরা মনে করেন, এই শ্রেণির মানুষ বেশি ড্রাই ক্লিনিং সেবা ব্যবহার করেন বলেই তাদের এক্সপোজার বেশি। অন্যদিকে, ড্রাই ক্লিনিং কারখানার কর্মীরাও দীর্ঘদিন সরাসরি এই রাসায়নিকের সংস্পর্শে থেকে আরও বড় ঝুঁকিতে আছেন।

PCE চোখে দেখা বা নাকে গন্ধ পাওয়া যায় না—তবে এটি খুব সহজেই বায়ুতে মিশে যায়। শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এটি রক্তে মিশে যায় এবং লিভার কোষের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। শরীর যখন এই রাসায়নিকটি ভাঙতে চেষ্টা করে, তখন “ট্রাইক্লোরোঅ্যাসেটিক অ্যাসিড” (TCA) নামের আরেকটি ক্ষতিকর যৌগ তৈরি হয়, যা লিভার কোষের মূল বিপাক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে।

গবেষক দল বলছে, এই অনুসন্ধান পরিবেশগত কারণগুলোর দিকে নতুনভাবে দৃষ্টি দিতে সাহায্য করবে। ড. লি বলেন, “যদি PCE এক্সপোজার পাওয়া ব্যক্তিদের আগে থেকেই লিভার ফাইব্রোসিসের জন্য স্ক্রিন করা যায়, তবে অনেক ক্ষেত্রেই রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।”

এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নাল Liver International-এ।