বুদ্ধিবিকাশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগ
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: বাংলাদেশে এক ভয়াবহ ও নীরব স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে রয়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে এক পিলে চমকানো তথ্য, দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি শিশু সীসা বা লেড দূষণে আক্রান্ত। রক্তে উচ্চমাত্রার এই সীসার উপস্থিতি শিশুদের মস্তিষ্ক, যকৃৎ ও কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধ্বংস করে দিচ্ছে, যা তাদের মানসিক বিকাশকে চিরতরে বাধাগ্রস্ত করছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. জাকারিয়া এই উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরে পরিস্থিতির ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করেন।
কীভাবে ক্ষতি করছে সীসা?
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া জানান, সীসা এমন একটি ভারী ধাতু যা একবার শরীরে প্রবেশ করলে সহজে বের হতে পারে না। এটি মানবদেহের মস্তিষ্ক, যকৃৎ (লিভার), কিডনি, হাড় এবং দাঁতে জমা হতে থাকে।
প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে সীসার প্রভাব অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। এ প্রসঙ্গে জাকারিয়া বলেন, “শিশুদের হাড় নরম হওয়ায় শরীরে প্রবেশ করা সীসা সরাসরি তাদের মস্তিস্কে চলে যায়। এর ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ (IQ) কমে যায়, মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে সহিংস আচরণের ঝুঁকি বাড়ে।”
দূষণের উৎস কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সীসা দূষণের প্রধান উৎসগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. খাদ্যে ভেজাল: বিশেষ করে হলুদের রঙ উজ্জ্বল করতে অসাধু ব্যবসায়ীরা এতে সীসা ক্রোমেট মিশিয়ে থাকে, যা রান্নার মাধ্যমে সরাসরি মানবদেহে প্রবেশ করে।
২. অবৈধ ব্যাটারি কারখানা: দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে আবাসিক এলাকায় নিয়ম না মেনে পুরাতন ব্যাটারি রিসাইক্লিং বা পোড়ানোর ফলে বাতাসে সীসা ছড়িয়ে পড়ছে।
৩. রং ও খেলনা: সস্তা খেলনা এবং বাড়িঘর রঙ করার পেইন্টে সীসার ব্যবহার শিশুদের জন্য বড় ঝুঁকির কারণ।
৪. শিল্পবর্জ্য: শিল্পকারখানার বর্জ্য মাটি ও পানিতে মিশে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকছে।
ভয়াবহ পরিসংখ্যান ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
ইউনিসেফ ও পিওর আর্থ-এর যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীসা দূষণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। রক্তে সীসার মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রাম বা তার বেশি হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে গণ্য হয়। বাংলাদেশের আক্রান্ত শিশুদের রক্তে এর চেয়েও বেশি মাত্রায় সীসা পাওয়া গেছে।
চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলছেন, সীসার প্রভাবে শিশুদের স্নায়ুতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এর ফলে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং শারীরিক বৃদ্ধি কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া কিডনি বিকল হওয়া এবং রক্তশূন্যতার মতো রোগের অন্যতম কারণও এই সীসা দূষণ।
করণীয় ও সতর্কতা
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই সংকট মোকাবিলায় অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন:
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে, বিশেষ করে মশলায় রঙের ব্যবহার বন্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে।
অবৈধ ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানাগুলো বন্ধ বা কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
শিশুদের খেলনা ও রঙে সীসার ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
একইসঙ্গে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যাতে মানুষ সীসার উৎসগুলো সম্পর্কে জানতে পারে এবং শিশুদের রক্ষা করতে পারে।
চেয়ারম্যান জাকারিয়া উল্লেখ করেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা শুধু কর্তৃপক্ষের কাজ নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি মেধাবী ও সুস্থ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সীসা দূষণ রোধে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।










