পর্ব-১
কামরুল ইসলাম: ২০০৩ সালের ১৯ মার্চের কথা। আমি তখন চট্টগ্রামভিত্তিক একটি দৈনিকের বিশেষ প্রতিনিধি। সেদিন জীবনের এক বিশেষ যাত্রায় বের হয়েছিলাম, বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মিয়ানমার সফর কাভার করতে। সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সৌজন্যে। চট্টগ্রাম থেকে আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন দৈনিক আজাদীর প্রধান প্রতিবেদক হেলালউদ্দিন চৌধুরী ( মরহুম )। আমাদের গন্তব্য ইয়াঙ্গুন, মিয়ানমারের প্রাণকেন্দ্র ও ঐতিহাসিক রাজধানী।
যাত্রাপথে বিমানে দেখা হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে। তিনি বিমানের প্রায় প্রতিটি যাত্রীর কাছে গিয়ে সৌজন্য বিনিময় করছিলেন। ইয়াঙ্গুন পৌঁছে আমরা উঠেছিলাম হোটেল ট্রেডার্সে (বর্তমানে “সেডোন ট্রেডার্স হোটেল ইয়াঙ্গুন”)। তিন দিনের সরকারি সফর হলেও অভিজ্ঞতা যেন কয়েক বছরের সমান দীর্ঘ।
প্রথম দিনেই কাজের ফাঁকে শহর ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। হেলালউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ইয়াঙ্গুনের রাস্তায়। শহরের শৃঙ্খলা, পুরনো ঔপনিবেশিক ভবন আর সোনালি ছটায় মোড়ানো বৌদ্ধ স্তূপগুলো মুগ্ধ করছিল। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল বিখ্যাত শ্বেডাগন প্যাগোডা। যা মিয়ানমারের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ধর্মীয় স্থাপনা। প্রবেশের আগে টিকিট কাটলাম স্থানীয়দের মতো। পরে জানতে পারলাম, বিদেশিদের প্রবেশমূল্য ৫ মার্কিন ডলার। সোনার পাতে মোড়ানো সেই বিশাল স্তূপে সূর্যের আলো পড়লে মনে হয়, পুরো শহর যেন আলোর মুকুট পরে আছে।

শ্বেডাগনের কাছেই দিল্লির নির্বাসিত শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি। ইতিহাসের পাতায় যাঁর নাম বহুবার পড়েছি, তাঁর নিঃশব্দ সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে বুকটা ভারী হয়ে উঠল। পরে জানতে পারলাম, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এক সফরে এই সমাধি দেখে গভীরভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং একসময় সেটি দিল্লিতে স্থানান্তরের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। সেই আবেগে হয়তো আমি নিজেও ভেসে গিয়েছিলাম, হেলালউদ্দিনের অজান্তে আরও দু’বার গিয়েছিলাম সেই সমাধি দেখতে।
দেয়ালে লেখা একটি পংক্তি আজও মনে পড়ে “কিতনা বদ নসীব হ্যায় জাফর, দাফনে কে লিয়ে দু গজ জমিন ভী না মিলি কু ইয়ার মে”। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মিয়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধি সৌধ পরিদর্শন করেন । সে সময় তিনি আক্ষেপভরা এই বিখ্যাত শায়েরীর জবাবে পরিদর্শক বইতে লিখেছিলেন “দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে , পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে”।
পাশেই সমাধিস্থ আছেন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্ত্রী বেগম জিনাতমহল।

শুক্রবারে গিয়েছিলাম ইয়াঙ্গুনের বাঙ্গালি সুন্নি মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে। নাম শুনে মনে হলো যেন চট্টগ্রামেরই কোনো পাড়া-মহল্লা। ভেতরে ঢুকে দেখি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উচ্চারণে কথা বলা মুসল্লিরা। কেউ কেউ নিজেদের পূর্বপুরুষের কথা বললেন, যারা একসময় আকিয়াব (বর্তমান সিত্তওয়ে) বা ইয়াঙ্গুনে এসে স্থায়ী হয়েছিলেন।
আমি মূলত শিপিং-সংক্রান্ত খবর লিখি, তাই সুযোগে কয়েকটি শিপিং অফিসেও গিয়েছিলাম। যাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। তারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ইয়াঙ্গুন বন্দরে। বিশাল জেটি, পুরনো ক্রেন আর শ্রমিকদের ব্যস্ততা দেখে মনে হলো, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী পাড়েরই আরেক প্রতিরূপ।
হেলালউদ্দিনের আত্মীয়-স্বজনদের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম কয়েকটি ঘরোয়া আড্ডায়। সেখানেই জানতে পারলাম, চট্টগ্রাম–রেঙ্গুন সম্পর্ক আসলে শতাব্দীপ্রাচীন। বাণিজ্য, আত্মীয়তা আর সংস্কৃতির বন্ধনে দুই উপকূল বহুদিন ধরে একে অন্যের প্রতিবিম্ব হয়ে আছে। বলা হয়, “রেঙ্গুনের নারীরা অতুলনীয় সুন্দরী” চট্টগ্রামের বহু পুরুষ সেই টানে বিয়ে করে স্ত্রী নিয়ে ফিরেছিলেন মাতৃভূমিতে। এখনো পুরনো চট্টগ্রামের গানগুলো সেই স্মৃতি ধরে রেখেছে—“ও শ্যাম রেঙ্গুন ন যাইও রে, কনে খাইব রেঙ্গুনের কামাই রে…”।
ইয়াঙ্গুনের সেই সফর আমার কাছে শুধু সাংবাদিকতার দায়িত্ব ছিল না, ছিল ইতিহাসের গভীরে ডুব দেওয়া এক মানবিক অভিজ্ঞতা। পুরনো সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ, চট্টগ্রামের স্মৃতি, আর বিদেশের মাটিতে নিজের শিকড় খুঁজে পাওয়ার অনুভব, সব মিলিয়ে আজও যেন ইয়াঙ্গুন আমার ভেতরে বেঁচে আছে।








