সাম্পান থেকে অট্টালিকা
শামসুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: কর্ণফুলীর মোহনায় ঢেউয়ের গর্জন আর পালের নৌকার আনাগোনা—এই দৃশ্য কেবল প্রকৃতির নয়, বরং চট্টগ্রামের হাজার বছরের বাণিজ্যিক ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। ঐতিহাসিকভাবেই চট্টগ্রাম ছিল বঙ্গোপসাগরের প্রবেশদ্বার। আর এই বাণিজ্যের হাত ধরেই এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল এক বিশাল ধনিক শ্রেণি, যাঁদের আমরা চিনি ‘সওদাগর’ নামে।
আর চট্টগ্রামের এই সমৃদ্ধি কেবল ব্যাংক-ব্যালেন্স বা সিন্দুকে সীমাবদ্ধ ছিল না; তা মিশে গিয়েছিল মানুষের মুখে মুখে ফেরা গানে এবং শহরের স্থাপত্যশৈলীতে।
চট্টগ্রামের অর্থনীতির সাথে বর্মা (বর্তমান মিয়ানমার) তথা রেঙ্গুনের সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য। এক সময় এখানকার সওদাগর ও শ্রমিকদের বড় একটা অংশ রেঙ্গুনে পাড়ি জমাতেন ভাগ্যান্বেষণে। এই প্রবাস জীবনের বিরহ আর ফিরে আসার আকুতি থেকেই জন্ম নিয়েছে অসংখ্য কালজয়ী গান ও পুঁথি।
আঞ্চলিক গানের সেই চিরচেনা সুর— “ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দেওয়ানা” কেবল একটি প্রেমের গান নয়, এটি তৎকালীন যাতায়াত ও বাণিজ্যের প্রধান বাহন ‘সাম্পান’ এবং এর মাঝিদের প্রতি এক ধরণের সামাজিক স্বীকৃতির বহিঃপ্রকাশ। রেঙ্গুন প্রবাসীদের নিয়ে লেখা পুঁথিগুলো আজও সেই সময়কার অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও পারিবারিক বিচ্ছেদের করুণ রসের সাক্ষী দেয়। বিনোদন এখানে কেবল আমোদ ছিল না, ছিল সওদাগরদের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
বাণিজ্যের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সওদাগররা চট্টগ্রামকে সাজিয়েছিলেন রাজকীয় ঢঙে। সওদাগরদের হাত ধরেই চট্টগ্রামে নির্মিত হয়েছে একের পর এক রাজকীয় অট্টালিকা। পাথরঘাটা, আন্দরকিল্লা কিংবা ফিরিঙ্গি বাজারের গলিগুলোতে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন অনেক ভব
এসব ভবনের স্থাপত্যশৈলী ইউরোপীয় এবং মুঘল ঘরানার মিশ্রণে তৈরি, ভবনগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে দামী মার্বেল পাথর আর কারুকার্যময় কাঠ। এই অট্টালিকাগুলো কেবল বসবাসের জন্য ছিল না, এগুলো ছিল বাণিজ্যিক আলোচনার মূল কেন্দ্র । এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতো চাল, ডাল, লবণ আর শুঁটকির বিশাল সব সিন্ডিকেট।
চট্টগ্রামের এই ধনিক শ্রেণি বাণিজ্যের পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতিরও বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বড় বড় সওদাগরদের বাড়িতে আয়োজন করা হতো মেজবান, যেখানে খাওয়ার পাশাপাশি চলত কবিয়াল গান ও পুঁথি পাঠের আসর। মূলত অর্থনীতি যখন শক্তিশালী হয়েছে, চট্টগ্রামের সংস্কৃতিও তখন মহীরুহ হয়ে উঠেছে।
সওদাগররা পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে কেবল অর্থ আনেননি, তাঁরা চট্টগ্রামকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আজ হয়তো সেই পাল তোলা সাম্পান নেই, কিন্তু আধুনিক বন্দরের বিশালাকার জাহাজগুলোর ভিড়ে এখনো সেই সওদাগরি আভিজাত্যের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
সওদাগরি ঐতিহ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একটি অঞ্চলের অর্থনীতি যখন মজবুত হয়, তখন তার শিল্প, সাহিত্য এবং স্থাপত্যও সমানতালে বিকশিত হয়। ইতিহাসের সেই ‘সাম্পানওয়ালা’ আর আজকের ‘শিপিং টাইকুন’—দুইই চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক ঐতিহ্যের দুই ভিন্ন পিঠ।










