Home অন্যান্য ভিয়েতনামি তরুণীর হৃদয়ে বাংলাদেশি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার

ভিয়েতনামি তরুণীর হৃদয়ে বাংলাদেশি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার

ছবি সংগৃহীত

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: হানয়ের ব্যস্ত নগরজীবন ডুবতে থাকে বিকেলের আলোয়। ঠিক সেই সময় ফাম থি নগক মাই দরজা খুলে ঘরে ঢোকেন। তার আগে থেকেই মাই দিন এলাকার ছোট্ট ফ্ল্যাটটি ভরে ওঠে ভিয়েতনামি খাবারের ঘ্রাণে। টেবিলভর্তি গরম ভাত, টাটকা সবজি, আর নিখুঁতভাবে রান্না করা মাছ। যেন কোনো অদৃশ্য পরী এসে সব গুছিয়ে রেখে গেছে। কিন্তু সেই পরী তো মানুষই, বাংলাদেশি যুবক শাহনেওয়াজ সাখাওয়াত।

মাই প্রায়ই বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, “তুমি ভিয়েতনামি রান্না শিখলে কবে?” জবাবে সাখাওয়াত হাসেন। সেই চেনা, উজ্জ্বল হাসি—যে হাসিতেই প্রথমবার মুগ্ধ হয়েছিলেন ২২ বছর বয়সী মাই।

তাদের পরিচয় ২০১৮ সালের শুরুতে, একদল বন্ধুর হাত ধরে। সাখাওয়াত তখন ভিয়েতনামে নতুন, সফটওয়্যার টেস্টার হিসেবে ব্যস্ত দিন শুরু করেছেন। আর মাই কাজ করছিলেন হোয়া বিন প্রদেশে একটি সামাজিক প্রকল্পে। ব্যস্ততার ভিড়ে তার বার্তাগুলো হয়তো অনেক সময়ই উত্তর পেত না, তবু সাখাওয়াত থামতেন না। একদিন হানয়ে সফরের সময় হোয়ান কিয়েম লেকের ধারে এক কফিশপে দেখা,  সেই দেখা যেন দুজনের জীবনের নতুন অধ্যায়ের প্রথম লাইন।

মাই বলেন, “সেদিন তার হাসি আমার ভিতরে আলো জ্বালিয়েছিল।” আর সাখাওয়াত মনে করেছিলেন, এই তরুণীর বুদ্ধি আর স্বপ্ন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন দিগন্তে।

ক্রমে তাদের কাছাকাছি আসা। একদিন দা নাঙে যাওয়া–ফেরা, আরেকদিন হঠাৎ মন খারাপ—ধীরে ধীরে দুজনই বুঝলেন এই অনুভূতি আর শুধু বন্ধুত্বে আটকে নেই। ফিরে এসে যখন মাই নিজের অনুভূতি জানালেন, সাখাওয়াত স্বীকার করলেন, অনেকদিন ধরেই একই আবেগ বুকের ভেতরে জমে ছিল।

তারপর দিনগুলো রঙিন হয়ে উঠল। মাইয়ের একাকী অফিস সফর ভরতি হয়ে গেল হাসি আর আলোয়। ব্যাকপ্যাক নিয়ে ভিয়েতনাম ঘোরা, ভালো খাবারের খোঁজে শহরের অলিগলি ঘোরা—সবকিছুতেই সাখাওয়াত হয়ে উঠলেন মাইয়ের সহযাত্রী।

কোভিড লকডাউনে দুজন ছুটে গেছেন দরিদ্র মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে। লং বিঅেন ব্রিজের নিচের দ্বীপে রাতের অন্ধকারে তারা খাবার দিয়েছেন পথের মানুষের হাতে। সাখাওয়াত বলেন, “ভালোবাসা শুধু দুজনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না; তা ছড়িয়ে পড়ে অন্য মানুষের প্রতিও।”

উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে মাই যখন বৃত্তি খুঁজছিলেন, তখন সাখাওয়াতই হয়ে উঠলেন তার সবচেয়ে বড় শক্তি। শত শত পাতা পড়া, মকের সাক্ষাৎকার নেওয়া, ভুল ধরিয়ে দেওয়া, সবকিছুতেই তিনি সঙ্গী। নিউজিল্যান্ডের বৃত্তি না পাওয়ার কষ্টে যখন মাই ভেঙে পড়ছিলেন, তখন সাখাওয়াত তাকে আলতো ধৈর্য আর সাহসে ধরে রেখেছেন। তার সেই উৎসাহই এক বছর পর মাইকে এনে দেয় অস্ট্রেলিয়া সরকারের বৃত্তি।

দুজনের ছয় বছরের পথচলা শেষ পর্যন্ত মিলিত হয় একটি সিদ্ধান্তে, বিয়ে। ২০২৪ সালের নভেম্বর, সাখাওয়াতের নিজ গ্রামের বাড়িতে হয় তাদের বিয়ে। মাইয়ের পরিবার দুই সপ্তাহ সেখানে থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি আর আতিথেয়তা উপভোগ করে।

তবে বিয়ের পরপরই আসে নতুন পরীক্ষা। নতুন চাকরি না পেয়ে মাই ভেতরে ভেতরে চাপে পড়ে যান। সামান্য জিজ্ঞেস করলেই তিনি কখনো কখনো রেগে উঠতেন। কিন্তু সাখাওয়াত তখনও আগের মতোই শান্ত—ধৈর্যের হাত বাড়িয়ে সিভি দেখে দেন, নতুন সুযোগ দেখিয়ে দেন। বলেন, “তোমাকে আমি ঘরে আটকে রাখতে চাই না। তুমি পৃথিবী দেখার মানুষ।”

এই কথাগুলোই মাইকে আবার শক্ত করে তোলে। ছয় মাস পর তিনি পান তার স্বপ্নের চাকরি।

শ্বশুরবাড়িতেও তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ স্নেহ। থাই বিনের বাড়িতে গেলে সাখাওয়াত নেমে পড়েন পুকুরে, মাছ ধরেন, ধান কাটেন, ঘরের কাজ করেন। শাশুড়ি–শ্বশুরের পছন্দের কেক, আইসক্রিমও তিনি ভুলে যান না।

এদিকে বাংলাদেশে প্রথমবার গেলে মাই হয়ে ওঠেন পরিবারের আপনজন। শাশুড়ি তাকে দেখে হাসতে–হাসতে কাঁদেন, শ্বশুর ভালোবাসায় তার জন্য কিনে আনেন বিয়ের পোশাক। আর টেবিলে সবসময় থাকে মাইয়ের জন্য চপস্টিক আর ছোট বাটি।

হানয়ের সেই ছোট্ট ঘরে প্রতিদিন ভোরে সাখাওয়াতের দিন শুরু হয় রান্নায়। দুপুরে কাজ থেকে ফেরে মাই, আর ঘর ভরে ওঠে গরম খাবারের সুগন্ধে।

মাই জিজ্ঞেস করেন, “এত যত্ন করো কেন?”
সাখাওয়াত একটু হেসে বলেন, “নিঃশর্ত ভালোবাসার সংজ্ঞা খুঁজতে গেলে হয়তো অনেক সময় লাগবে। কিন্তু আমি যা করি, সবই তারই অংশ।”

লাইক দিন 👍, শেয়ার করুন 🔁, এবং মন্তব্যে জানান আপনার মতামত