বিকল্প উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতা
তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: বিশ্বব্যাপী অন্যতম “হাই-এমিশন” খাত হিসেবে পরিচিত সিমেন্ট শিল্প এখন বড় ধরনের রূপান্তরের পথে। সিমেন্ট উৎপাদনে চুনাপাথর (লাইমস্টোন) থেকে ক্লিংকার তৈরির সময় বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। একই সঙ্গে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উচ্চমাত্রার জ্বালানি ব্যবহারের কারণে পরিবেশগত চাপ আরও বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্প খাতের মোট কার্বন নির্গমনের প্রায় ৭-৮ শতাংশের জন্য সিমেন্ট এককভাবে দায়ী।
এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে সিমেন্ট কোম্পানিগুলো এখন নিম্ন-কার্বন সিমেন্ট, বিকল্প জ্বালানি এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। কার্বন ক্যাপচার, ইউটিলাইজেশন ও স্টোরেজ প্রযুক্তি, শিল্পের ডিকার্বনাইজেশন এজেন্ডায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন নির্মাতা কোম্পানি ক্লিংকার ব্যবহারের পরিমাণ কমানো এবং বিকল্প কাঁচামাল অন্তর্ভুক্তির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
মেক্সিকোভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সিমেক্স সম্প্রতি “মাইক্রোনাইজিং” নামে এক নতুন প্রক্রিয়া চালুর ঘোষণা দিয়েছে। এই পদ্ধতিতে ক্লিংকারকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে প্রসেস করা হয়, ফলে সিমেন্টে ক্লিংকারের অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এর মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমার পাশাপাশি কার্বন নির্গমনও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উদ্ভাবন ভবিষ্যতের সবুজ সিমেন্ট উৎপাদনের বড় পদক্ষেপ হতে পারে।
শুধু সিমেক্সই নয়, লাফার্জহলসিম, হাইডেলবার্গ মেটেরিয়ালসসহ শীর্ষ কোম্পানিগুলোও বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান অন্তর্ভুক্ত করে কার্বন ফু্টপ্রিন্ট কমানোর কৌশল হাতে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের বাজারও এ বৈশ্বিক প্রবণতা থেকে পিছিয়ে নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দেশীয় সিমেন্ট শিল্পকে দ্রুত নিম্ন-কার্বন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত করতে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তির প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে উঠবে।
বিশ্বব্যাপী সিমেন্ট বাজার ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখী হলেও আঞ্চলিক বৈষম্য স্পষ্ট। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় পরিবেশবান্ধব নীতিমালা ও কারিগরি মানদণ্ড কঠোর হওয়ায় সেখানে গ্রিন সিমেন্টের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। অন্যদিকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ও স্থানীয় সরবরাহ-শৃঙ্খলার ওপর নির্ভর করে দামের ওঠানামা বেশি দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং কাঁচামালের সরবরাহ সংকট দেখা দিলে ক্লিংকার ও সিমেন্টের দাম প্রায়শই পরিবর্তনশীল হয়।
ভারতের বাজারে প্রবণতা
২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সিমেন্টের চাহিদা বেড়েছে, যার প্রভাবে ব্যাগপ্রতি দামেরও উল্লম্ফন ঘটেছে। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে বাজার তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে, যেখানে কিছু ক্ষেত্রে ৮% পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে। এই আঞ্চলিক শক্তি দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক দামের প্রবণতাকেও প্রভাবিত করছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার সারাংশ
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গ্রিন সিমেন্ট ও ব্লেন্ডেড পণ্যের সরবরাহ বাড়তে থাকলে—যদি উৎপাদন খরচ প্রতিযোগিতামূলক রাখা যায়—দীর্ঘমেয়াদে ক্লিংকার সরবরাহ ও আকস্মিক আমদানিনির্ভরতার চাপ সত্ত্বেও বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকবে। তবে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের চাহিদা বা কাঁচামালের সংকট দেখা দিলে দাম ওঠানামা অব্যাহত থাকতে পারে।