পাহাড়ের প্রান্তে এক সম্ভাবনাময় জনপদ’- পর্ব: ২
মো. মাসুদ রানা, রামগড় ( খাগড়াছড়ি): রামগড় এখনো অনেকের কাছে একটি অখ্যাত সীমান্ত শহর। কিন্তু ইতিহাসের পৃষ্ঠায় গেলে দেখা যাবে, ব্রিটিশ আমল থেকেই এ অঞ্চলের ছিল কৌশলগত গুরুত্ব। বিশেষত উপনিবেশিক প্রশাসন, সামরিক নজরদারি, চা শিল্প এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রামগড় এক গুরুত্বপূর্ণ গার্ড পোস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
১৮৬০ সালের পর যখন ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রশাসনিকভাবে রিজিওনাল ডিভিশনে ভাগ করে, তখন রামগড় ছিল একটি ‘সাবডিভিশন হেডকোয়ার্টার’। এটি ছিল মূলত ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর একটি সীমান্ত ঘাঁটি, যার মাধ্যমে তারা পাহাড়ি অঞ্চলের ওপর নজর রাখত। ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আসা যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলন বা সামরিক হুমকিকে থামিয়ে দিতে রামগড় ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক পয়েন্ট। রামগড়ের পোস্টিংকৃত ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের দপ্তর ছিল পাহাড়ের ওপর নির্মিত লাল ইটের ভবনে, যার ধ্বংসাবশেষ এখনও স্থানীয়রা ‘সাহেব বাড়ি’ নামে চেনে।
রামগড় চা শিল্পেও এক সময় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। উনিশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশরা এখানে প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান স্থাপন করে। বিশেষ করে ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বেশ কিছু ছোট চা বাগান গড়ে ওঠে, যা মূলত ইউরোপীয় এবং কিছু ধনী স্থানীয় জমিদারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই বাগানগুলোতে ত্রিপুরা ও চাকমা জনগোষ্ঠীর শ্রমিক হিসেবে কাজ করার ইতিহাস আজও লোকমুখে শোনা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রামগড় হয়ে ওঠে এক কৌশলগত রুট। তৎকালীন বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) ফ্রন্টে সৈন্য পাঠাতে ব্রিটিশরা রামগড় থেকে শুরু করে ময়ূরটিলা, তারপর সাবরুম হয়ে কুমিল্লা পর্যন্ত এক বিকল্প সাপ্লাই রুট তৈরি করে। স্থানীয় প্রবীণদের মতে, সে সময় বড় বড় ট্রাক ও জিপ গাড়ি পাহাড়ি পথে চলত, যার জন্য বিশেষ ‘মেটাল রোড’ বিছানো হয় ফেনী নদীর ধার বরাবর। আজ তার আর কোনো চিহ্ন নেই, তবে কিছু জায়গায় লোহার পাত ও ইটের ভগ্নাংশ পাওয়া যায় এখনো।
ব্রিটিশ প্রশাসনের আমলে পাহাড়ি জনগণের ওপর নানা বিধিনিষেধ ছিল। বিশেষ অনুমতি ছাড়া পাহাড়ে যাতায়াত, জমি কেনাবেচা বা ব্যবসা করা নিষিদ্ধ ছিল। তবুও রামগড় ছিল এক ধরনের সভ্যতার প্রান্তভাগ, যেখানে চা বাগান, সীমান্ত চেকপোস্ট আর সামরিক দপ্তর মিলিয়ে একটা ‘অন্তর্মুখী প্রশাসনিক সমাজ’ গড়ে উঠেছিল।
রামগড়ের প্রাচীন ডাকবাংলো, সাহেবদের গেটওয়ে, পাহাড়ি সড়ক ও পুরোনো প্রশাসনিক ভবনের ধ্বংসাবশেষ আজও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। স্থানীয় অনেকেই মনে করেন, রামগড়ের ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস সংরক্ষণ করে তা পর্যটনের আওতায় আনা গেলে একদিকে যেমন ইতিহাস বাঁচত, অন্যদিকে স্থানীয় অর্থনীতিও লাভবান হতো।
আগামী পর্বে আমরা তুলে ধরব ‘‘সীমান্তে জীবন – নিরাপত্তার কাঁটাতার আর সম্ভাবনার অপেক্ষা”