বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, সিলেট: সিলেটের আলোচিত সাদাপাথর লুটপাটের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক তদন্ত প্রতিবেদন ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছে স্থানীয় রাজনীতি ও প্রশাসন। প্রতিবেদনে শীর্ষ রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নাম উঠে আসায় শুরু হয়েছে ব্যাপক তোলপাড়। অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতারা দুদকের রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, দুদককেই এই রিপোর্টের সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। একের পর এক সংবাদ সম্মেলন করে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করছেন। এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানে সিলেটের রাজনীতিতে চলছে তুমুল জল্পনা।
দুদকের ‘বোমা ফাটানো’ প্রতিবেদন
সম্প্রতি দুদকের এনফোর্সমেন্ট কমিটির একটি তদন্ত দল সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শন শেষে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনে পাথর লুটের ঘটনায় ৪২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করা হয়। এই তালিকায় নাম রয়েছে সিলেট নগর বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, নগর জামায়াতের আমীর মো. ফখরুল ইসলাম এবং জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীনের মতো শীর্ষস্থানীয় নেতাদের।
প্রতিবেদনে বিএনপি’র ২১ জন, জামায়াতের ২ জন, আওয়ামী লীগের ৭ জন এবং এনসিপির ২ জন নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া প্রভাবশালী পাথর ব্যবসায়ী ও স্থানীয় অনেকের নামও রয়েছে তালিকায়।
তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, এই লুটের ভাগের টাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারের (এসপি) মতো শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছেও যেত বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ আনা হয়েছে। বিভাগীয় কমিশনার থেকে শুরু করে থানার ওসি পর্যন্ত অনেকের নিষ্ক্রিয়তা ও কমিশন গ্রহণের অভিযোগ তোলা হয়েছে এতে।
রাজনৈতিক নেতাদের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুদকের প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসতেই ফুঁসে উঠেছেন অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতারা। জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে নগর বিএনপি’র নেতারা এই রিপোর্টকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। তারা বলেন, “আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, এই অপকর্মের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না। তালিকার সত্যতা দুদককেই নিশ্চিত করতে হবে।” তারা জানান, পাথরকোয়ারি বৈধভাবে খুলে দেওয়ার দাবিতে তারা আন্দোলনে গিয়েছিলেন, লুটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
একই সুরে কথা বলেছে জামায়াতে ইসলামীও। সংবাদ সম্মেলনে নগর জামায়াতের আমীর মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, “সব ধরনের লুটপাটের বিরুদ্ধে জামায়াত বরাবরই সোচ্চার। আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন।” তিনি আরও জানান, তারা দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও রিপোর্টের সত্যতা নিশ্চিত হতে পারেননি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) নেতারাও এই প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। দলের জেলার প্রধান সমন্বয়ক নাজিম উদ্দিন শাহান বলেন, “আমাদের ন্যূনতম সম্পর্ক যদি প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে দেশের আইনে যে বিচার হবে, আমরা তা মাথা পেতে নেব।”
একের পর এক তদন্ত কমিটি
দুদকের এই রিপোর্টের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটিও তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে ১২৩ জনের নাম উঠে এসেছে। পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নেওয়ায় এবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তৃতীয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি মূলত প্রশাসনের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বলে জানা গেছে।
এদিকে, সিলেটের নবাগত জেলা প্রশাসক সরওয়ার আলম সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, “প্রাকৃতিক সম্পদ যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। এটা শুধু প্রশাসনের একার দায়িত্ব নয়, সকলকেই দায়িত্ব নিতে হবে।”
এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং একাধিক তদন্তের ডামাডোলে সাদাপাথর লুটের পেছনের আসল সত্য উদঘাটনের অপেক্ষায় এখন পুরো সিলেট। রাজনৈতিক চাপ নাকি প্রকৃত অর্থেই দুর্নীতির মূলোৎপাটন হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর সময়ই বলে দেবে।