কোমর থেকে পায়ে টান ধরার যন্ত্রণায় যখন জীবন থমকে দাঁড়ায়
হেলথ ডেস্ক:
চল্লিশোর্ধ্ব ফারহানা ইয়াসমিন, পেশায় একজন স্কুলশিক্ষিকা। গত ছয় মাস ধরে এক অদ্ভুত ব্যথায় ভুগছেন তিনি। প্রথমে ভেবেছিলেন পিঠে হালকা ব্যথা, সময়ের সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যথাটা কোমর থেকে পায়ের পেছন দিক বেয়ে নিচে নামতে থাকে। আজকাল হাঁটতে গেলেও টান লাগে, কখনো হঠাৎ পা অবশ হয়ে যায়। শেষে চিকিৎসকের কাছে গেলে জানতে পারেন, তিনি সায়াটিকায় আক্রান্ত।
ফারহানা বললেন, “প্রথমে মনে হতো পিঠে ব্যথা, ব্যথানাশক খেলেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাস্তা পার হতে গিয়ে ব্যথায় থেমে গেলাম। তখন বুঝলাম, বিষয়টা সাধারণ না। এখন বুঝি, অবহেলা না করে আগে গেলে হয়তো এতটা যন্ত্রণায় পড়তাম না।”
কী এই সায়াটিকা?
সায়াটিকা একধরনের স্নায়ুজনিত ব্যথা, যা কোমর থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব ও পায়ের পেছনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ব্যথার উৎস হচ্ছে শরীরের দীর্ঘতম স্নায়ু সায়াটিক নার্ভ, যা মেরুদণ্ডের নিচের অংশ থেকে শুরু হয়ে পায়ের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত।
ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিউরো-মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মাহমুদ হাসান বলেন,
“যখন সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়ে, তখন এই ব্যথা দেখা দেয়। রোগীরা সাধারণত কোমর থেকে শুরু হওয়া পায়ের পেছনে বিস্তৃত একতরফা টান ধরনের ব্যথার কথা বলেন। সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে এটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল ব্যথায় পরিণত হতে পারে।”
কী কারণে হয় সায়াটিকা?
সায়াটিকার কারণ হতে পারে—
- কোমরের ডিস্ক সরে গিয়ে নার্ভে চাপ দেওয়া
- মেরুদণ্ডের হাড়ে পরিবর্তন বা স্পাইনাল স্টেনোসিস
- অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাওয়া
- দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা
- হঠাৎ ভারী জিনিস তোলা
- দুর্ঘটনায় আঘাত পাওয়া
- ডায়াবেটিসের ফলে স্নায়ু দুর্বল হয়ে যাওয়া
ডা. মাহমুদ বলেন,
“বর্তমানে যারা দীর্ঘ সময় কম্পিউটার বা ডেস্কে বসে কাজ করেন, তাদের মধ্যে এই রোগ দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে ৩০-৫০ বছর বয়সী নারী ও পুরুষ রোগী বেশি আসছেন।”
রোগীর জীবন কেমন হয়?
৪৫ বছর বয়সী মো. হাসান আলী, একজন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক। ২০২৩ সালের শেষ দিকে হঠাৎ পায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ব্যথা শুরু হয়। শুরুতে এক হাকিমের কাছে গিয়ে তেল মাখতেন। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। পরে ঢাকায় এসে এক হাসপাতালে এমআরআই করান। ধরা পড়ে—সায়াটিক নার্ভ চেপে যাচ্ছে কোমরের একটি ডিস্ক।
তিনি বলেন,
“রিকশা চালালে কোমরে ঝাঁকুনি লাগে, ব্যথা বাড়ে। কিন্তু না চালালে ঘরে চাল আসবে না। এখন ব্যথা নিয়ে কাজ করি, রাতে ঘুম হয় না। ডাক্তার বলেছেন, বিশ্রাম দরকার, কিন্তু আমি কি বিশ্রাম নিতে পারি?”
চিকিৎসা কী?
সায়াটিকার চিকিৎসা নির্ভর করে ব্যথার তীব্রতা ও সময়ের ওপর। প্রাথমিক পর্যায়ে—
- বিশ্রাম ও ওষুধ
- গরম সেঁক বা ফিজিওথেরাপি
- ব্যথা কমানোর ইনজেকশন
- দৈনন্দিন কাজে কিছু পরিবর্তন
ডা. মাহমুদ জানালেন,
“রোগীর ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার ছাড়াই ব্যথা নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে যাদের স্নায়ু মারাত্মক চাপে থাকে বা পা অবশ হয়ে যাচ্ছে, তাদের সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।”
সচেতনতা জরুরি
বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক জীবনাচার ও নিয়মিত ব্যায়ামে সায়াটিকা প্রতিরোধ সম্ভব। নিচের নিয়মগুলো মানলে ঝুঁকি অনেক কমে যায়:
- দীর্ঘ সময় বসে থাকবেন না
- ভারী কিছু তোলার সময় কোমর না বাঁকিয়ে হাঁটু ভাঁজ করুন
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন
- কাজের মাঝে মাঝেমধ্যে উঠে হাঁটুন বা হালকা স্ট্রেচিং করুন
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন