Home পর্যটন খরিফে সালালাহ: মরুভূমির বুকে সবুজ স্বপ্নভ্রমণ

খরিফে সালালাহ: মরুভূমির বুকে সবুজ স্বপ্নভ্রমণ

মাহবুবুল হক, মাস্কাট ( ওমান ): মরুভূমির দেশ ওমান। কিন্তু বছরের নির্দিষ্ট সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের সালালাহ যেন পরিণত হয় এক অন্য জগতে। ধূসর পাহাড় ঢেকে যায় সবুজে, মেঘ ছুঁয়ে যায় উপত্যকা, আর ঝরনার স্রোত নেমে আসে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে। এই মৌসুমটিই খরিফ — যার টানে প্রতিবছর হাজারো মানুষ ছুটে আসেন প্রকৃতির অনন্য এই উৎসবে।

সম্প্রতি মাজান ট্রাভেলস-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান মাই উইংস হলিডেজ ঘরোয়া পর্যটকদের জন্য বিশেষ গ্রুপ ট্যুর আয়োজন করেছে। আমিও যোগ দিলাম সেই ভ্রমণে, মাসকাট থেকে সালালাহর পথে।

যাত্রার শুরু: মরুভূমি পেরিয়ে সবুজে

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় মাসকাট ছাড়ল আমাদের এয়ার-কন্ডিশন্ড বাস। ৫০ জনের উচ্ছ্বসিত দল, ব্যাগ ভর্তি প্রত্যাশা আর টিফিন বক্সে রাতের খাবার। দীর্ঘ বারো ঘণ্টার রাতযাত্রা শেষে ভোরের আলোয় ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়ল কুয়াশায় মোড়া সালালাহ। বৃষ্টির ফোঁটা আঁকিবুঁকি কেটেছে জানালার কাঁচে। মনে হল—মরুভূমি নয়, এ যেন স্বপ্নলোক।

প্রথম দিন: পাহাড়, সমুদ্র আর মুগ্ধতার ঝরনা

হোটেল অ্যাপার্টমেন্টে নাস্তা সারতেই অপেক্ষায় ছিল ইংরেজিভাষী ওমানি গাইড। প্রথম গন্তব্য ইত্তিন পর্বত—কুয়াশায় আচ্ছন্ন আঁকাবাঁকা রাস্তা, পাথুরে খাদ আর ধূসর আকাশে সাদা মেঘ।

এরপর আয়ন জেরজিজ ঝরনা; শ্যাওলা ঢাকা শিলাখণ্ড থেকে নেমে আসা জলধারা মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির নির্মলতা। পথেই ঘুরে এলাম প্রবক্তা আয়ুবের সমাধি, যেখানে আধ্যাত্মিক শান্তি ছড়িয়ে আছে চারপাশে।

দুপুরে পৌঁছলাম মুঘসাইল সৈকতে—নীলাভ ঢেউ গর্জে উঠছে শিলাময় তটে। পাশেই বিখ্যাত মারনীফ কেভ ব্লো-হোলস; ঢেউয়ের ধাক্কায় ফুঁসে ওঠা সাগরের জল উড়ে গেল কয়েক মিটার উঁচুতে। মুহূর্তেই ভিজে গেলাম লবণাক্ত ফোঁটায়, আর সমুদ্রের সঙ্গে নিজের ক্ষুদ্রতা অনুভব করলাম নতুনভাবে।

দ্বিতীয় দিন: খরিফের প্রাণকেন্দ্র

শনিবারের সকাল শুরু ওয়াদি দারবাতে। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝরনা, সবুজ কার্পেটে মোড়া উপত্যকা আর হাজারো মানুষের ভিড়। কেউ বসেছে পারিবারিক পিকনিকে, কেউ নেমেছে নৌকায়, আবার কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটে যাচ্ছে নদীর ধারে। শিশুরা বেলুন খেলায় ব্যস্ত, আর আকাশ জুড়ে ভেসে যাচ্ছে জিপলাইনের চিৎকার।

নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়্যাল ওমান পুলিশের দল টহল দিচ্ছে নির্ভার হাসি নিয়ে। ফায়ার সার্ভিস সদস্য আয়মান বললেন,
“সপ্তাহান্তে প্রায় হাজারো পর্যটক আসে এখানে। ভিড় থাকলেও সবাই সচেতন। বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটে না।”

এরপর একে একে ঘুরে এলাম তাওই আতাইর সিঙ্কহোল, জাবাল সামহান ভিউপয়েন্ট যেখানে মেঘের সমুদ্র গড়িয়ে পড়ে পাহাড়ি খাদে। ওয়াদি হিন্নার শতবর্ষী বৃক্ষ দেখে মনে হল, প্রকৃতিও যেন ইতিহাস লিখে রেখেছে শিকড়ের গহ্বরে।

দিনের শেষে তাকাহ দুর্গ আর সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল জেলেদের ব্যস্ততা। গোধূলির আলোয় ছড়িয়ে পড়ল খরিফের শান্ত সুর।

ফেরার পথে স্মৃতির ঝুলি

রাত নেমে আসতেই ফেরার প্রস্তুতি। বাসে উঠে অনেকেই আক্ষেপ করছিলেন ফলের বাজার ঘুরে দেখা হলো না বলে। কিন্তু মাজান টিম যাত্রীদের নিরাশ করল না ৩০ মিনিটের বিরতিতে সবাই মিলে কিনে নিলাম তাজা পেঁপে, নারকেল আর আম।

মাসকাট ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, খরিফ কেবল দৃশ্য নয় এ এক অনুভূতি। গরম মরুভূমির বুকে বৃষ্টির ছোঁয়া, মেঘে মোড়া পাহাড়, আর ভ্রমণসঙ্গীদের হাসিমুখ সব মিলিয়ে এটি ছিল জীবনের জন্য এক পুনর্জাগরণ।

ভ্রমণ টিপস

  • সেরা সময়: জুন থেকে সেপ্টেম্বর (খরিফ মৌসুম)
  • অবস্থান: সালালাহ, ধোফার প্রদেশ, ওমান
  • অবশ্যই ঘুরবেন: ওয়াদি দারবাত, মুঘসাইল সৈকত, আয়ুব নবীর সমাধি, জাবাল সামহান
  • ট্রাভেল অপশন: মুসকট থেকে রাতের বাস বা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট
  • স্মারক: লোবান (ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স), খেজুর, স্থানীয় ফল

👉 সালালাহ খরিফ মৌসুমে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গ। আপনি কি কখনও এই মরুভূমির বুকে সবুজের উৎসব দেখেছেন?