Home কক্সবাজার দিনে ৯০০ জনের বেশি পর্যটক নয়: সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে আসছে কঠোর বিধিনিষেধ

দিনে ৯০০ জনের বেশি পর্যটক নয়: সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে আসছে কঠোর বিধিনিষেধ

‘বাঁচবে প্রবাল, বাঁচবে দ্বীপ: সেন্ট মার্টিনের আগামীর রূপরেখা’
পর্ব-২


কামরুল ইসলাম, ঢাকা: শীতের ছুটিতে সেন্ট মার্টিন মানেই হাজার হাজার পর্যটকের ঢল। জাহাজ থেকে নামার জায়গাটুকু পর্যন্ত পাওয়া দায়। কিন্তু সব ঠিক থাকলে আগামী বছর থেকে এই চিত্র আর দেখা যাবে না। সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের সেই ‘অবারিত সুযোগ’ আর থাকছে না। দ্বীপটিকে বাঁচাতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রণীত খসড়া মাস্টার প্ল্যানে পর্যটকদের জন্য একগুচ্ছ কঠোর বিধিনিষেধের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসছে পর্যটকের সংখ্যায়। মাস্টার প্ল্যানে প্রস্তাব করা হয়েছে, দ্বীপের ধারণক্ষমতা বিবেচনায় দিনে সর্বোচ্চ ৯০০ জন পর্যটককে দ্বীপে রাতযাপনের অনুমতি দেওয়া হবে।

কেন এই কঠোর সিদ্ধান্ত?
মাস্টার প্ল্যানের ৩য় অধ্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পিক সিজনে প্রতিদিন গড়ে ৩,০০০ থেকে ৭,০০০ পর্যটক সেন্ট মার্টিনে ভিড় করেন। অথচ দ্বীপটির ‘কার্যকর পর্যটন ধারণক্ষমতা’ (Effective Carrying Capacity) দৈনিক সর্বোচ্চ ৯০০ জন।
অতিরিক্ত এই চাপের কারণে দ্বীপের ভূগর্ভস্থ পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে এবং প্রবাল ও সামুদ্রিক কচ্ছপের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। তাই মাস্টার প্ল্যানে পর্যটক নিয়ন্ত্রণকে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ দেওয়া হয়েছে।

ভ্রমণের নতুন নিয়ম: যা থাকছে প্রস্তাবে
খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইচ্ছা করলেই আর ব্যাগ গুছিয়ে সেন্ট মার্টিন যাওয়া যাবে না। এর জন্য মানতে হবে বেশ কিছু ধাপ:

১. অনলাইন রেজিস্ট্রেশন (SMT-MIS): মাস্টার প্ল্যানের প্রজেক্ট ST-01 অনুযায়ী, ‘সেন্ট মার্টিন ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’ নামে একটি অ্যাপ বা পোর্টাল চালু করা হবে। পর্যটকদের আগে থেকে সেখানে নিবন্ধন করতে হবে।
২. নির্দিষ্ট কোটা: প্রতিদিন মাত্র ৫০০ থেকে ৯০০ জন পর্যটককে নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়া হবে। কোটা পূরণ হয়ে গেলে ওই দিনের জন্য আর কেউ টিকেট পাবেন না।
৩. প্রবেশ ফি: দ্বীপে প্রবেশের জন্য পর্যটকদের নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে, যা দ্বীপের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে ব্যয় হবে।
৪. জাহাজ নিয়ন্ত্রণ: টেকনাফ ও কক্সবাজার থেকে কয়টি জাহাজ যাবে এবং তাতে কতজন যাত্রী থাকবে, তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (BIWTA) ও পরিবেশ অধিদপ্তর।

ছেঁড়া দ্বীপে প্রবেশ নিষেধ?
পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র ‘ছেঁড়া দ্বীপ’ বা ছেঁড়াদিয়া। মাস্টার প্ল্যানের জোনিং ম্যাপ (জোন-৪) অনুযায়ী, ছেঁড়া দ্বীপ এবং এর সংলগ্ন এলাকাকে ‘সংরক্ষিত এলাকা’ বা ‘Strict Nature Reserve’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর অর্থ হলো—

ছেঁড়া দ্বীপে সাধারণ পর্যটকদের অবাধ বিচরণ নিষিদ্ধ হতে পারে।

সেখানে কোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী দোকানপাট থাকবে না।

রাতে সেখানে অবস্থান বা ক্যাম্পিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

শুধুমাত্র গবেষণার কাজে বা বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে সীমিত সময়ে সেখানে যাওয়া যাবে।

হোটেল ও রিসোর্টের ভবিষ্যৎ
বর্তমানে দ্বীপে ১০৯টিরও বেশি হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে। মাস্টার প্ল্যানে বলা হয়েছে, নতুন করে আর কোনো হোটেল বা রিসোর্ট নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে না। এমনকি বর্তমানে যারা অবৈধভাবে সৈকত দখল করে স্থাপনা করেছেন, সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে। পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা শুধুমাত্র ‘সাধারণ ব্যবহার জোন’ (জোন-১)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

পর্যটকদের জন্য ‘ডু’স অ্যান্ড ডোন্ট’স’
আগামীর সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের আচরণের ওপরও কড়া নজরদারি থাকবে। খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী:

  • নিষিদ্ধ: সৈকতে উচ্চস্বরে গান বাজানো, বারবিকিউ পার্টি করা, এবং রাতে আলো জ্বালিয়ে হইচই করা (যা কচ্ছপের ডিম পাড়ায় বাধা দেয়)।
  • নিষিদ্ধ: প্লাস্টিকের বোতল বা চিপসের প্যাকেট যত্রতত্র ফেলা। ‘সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক’ দ্বীপে নেওয়াই নিষিদ্ধ হতে পারে।
  • বাহন: দ্বীপে কোনো মোটরচালিত ভ্যান বা বাইক চলবে না। ঘুরতে হবে পায়ে হেঁটে অথবা পরিবেশবান্ধব রিকশা/বাইসাইকেলে।

মতামত দেওয়ার সুযোগ
সরকার এই কঠোর নিয়মগুলো চূড়ান্ত করার আগে সাধারণ মানুষের মতামত নিচ্ছে। ২০ ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনি জানাতে পারেন—দিনে ৯০০ পর্যটকের এই সীমা কি যৌক্তিক? নাকি এর ফলে মধ্যবিত্তের ভ্রমণের সুযোগ সংকুচিত হবে?

দ্বীপ বাঁচানো আর পর্যটন চালু রাখা—এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।


পরবর্তী পর্ব: চার ভাগে ভাগ হচ্ছে সেন্ট মার্টিন: কোথায় ঘুরবেন, কোথায় নিষিদ্ধ? (চোখ রাখুন আগামীকালের সংখ্যায়)