Home অন্যান্য ৬২ বছরের গুহাবাসী মানুষ: সভ্যতার বাইরের এক আশ্চর্য জীবন

৬২ বছরের গুহাবাসী মানুষ: সভ্যতার বাইরের এক আশ্চর্য জীবন

ফিচার 

আমিরুল মোমেনিন: ভোর হলেই জেগে ওঠেন তিনি, কোনো ঘড়ি বা অ্যালার্ম ছাড়াই। সূর্যের আলো, সাগরের ঢেউ আর বাতাসের শব্দই যেন তাঁর প্রাকৃতিক ঘড়ি। নাম আলিয়াহ। বয়স পেরিয়েছে ৬০। তিনি বাস করেন ইয়েমেনের সোকোত্রা দ্বীপের এক পাথুরে উপকূলে, একটি গুহার মধ্যে। এই মানুষটি বেছে নিয়েছেন এমন এক জীবন যেখানে নেই কোনো বিদ্যুৎ, মোবাইল বা আধুনিক যন্ত্রের ছোঁয়া। তাঁর পুরো দিন কাটে প্রকৃতির নিয়ম মেনে, কেবল সমুদ্র আর গুহার সাথে।

তিনি ঘড়িতে সময় দেখেন না। তাঁর জন্য সময়ের মাপকাঠি হল জোয়ার-ভাটার আসা যাওয়া। খালি পায়ে হেঁটে বেড়ান পাথরের ওপর দিয়ে, যেন তা মোলায়েম বালুর চেয়ে কম কিছু নয়। খাবারের জন্য তিনি খালি হাতে মাছ ধরেন, ফল-মূল খোঁজেন উপকূলীয় ঝোপঝাড়ে। রাতে শুয়ে পড়েন গুহার একপাশে বিছানো সামান্য খড়কুটোর ওপর।

তাঁর মুখে সর্বক্ষণ এক ধরনের নির্মল হাসি খেলে যায়। কেউ কেউ বলেন, সেই হাসিতে যেন লুকিয়ে আছে এমন এক জ্ঞান, যা আধুনিক মানুষ ভুলে গেছে। আলিয়াহর মুখে শোনা যায় ভাঙা ভাঙা ইংরেজি, যা তিনি শিখেছেন কৌতূহলী পর্যটকদের কাছ থেকে। একটি বার্তা দিতে গিয়ে বলেন,
“সি গিভস, আই টেক, আই থ্যাঙ্ক, দ্যাট ইজ লাইফ”
বাংলায় যার অর্থ, সমুদ্র দেয়, আমি নেই, আমি কৃতজ্ঞ থাকি, এটাই জীবন।

তবে কেমন করে এই বিচ্ছিন্ন জীবনে এলেন আলিয়াহ?

ভ্রমণকারীদের মুখে মুখে পাওয়া তথ্য বলছে, আলিয়াহ জন্মেছিলেন ইয়েমেনের হাদরামাউত অঞ্চলে। তাঁর পরিবার একসময় হারিয়ে যায় রাজনৈতিক অস্থিরতা আর যুদ্ধের ধাক্কায়। অল্প বয়সেই তিনি হয়ে পড়েন গৃহহীন। কখনো শ্রমিক, কখনো নৌকার মাঝি হয়ে দিন চলত তাঁর। কিন্তু শহুরে জীবনের হিংস্রতা ও কোলাহল একসময় তাঁকে আঘাত করে।

সেই আশির দশকের শেষ দিকে একবার একটি মাছ ধরার নৌকায় চড়ে তিনি পাড়ি জমান সোকোত্রা দ্বীপে। প্রথমে দ্বীপের গ্রামে বসবাস করলেও ধীরে ধীরে নির্জনতা আর প্রকৃতির টানেই চলে যান জনবসতির বাইরে, উপকূলের এক গুহায়। সেখানে শুরু হয় তাঁর প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংলাপ। সময় গড়িয়েছে, কিন্তু আলিয়াহ থেকে গেছেন ঠিক তেমন, একাকী, নিঃশব্দ, প্রকৃতি নির্ভর।

তাঁর অস্তিত্ব আজ এক জীবন্ত দলিল, সভ্যতার বাইরে বেঁচে থাকার সম্ভাবনার।
তাঁর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে পর্যটকরা বিস্ময়ে হতবাক হন। এক ব্যক্তি এতটা শান্ত, এতটা নিরুপদ্রব হয়ে কীভাবে জীবন কাটাতে পারেন, তা তাদের ভাবিয়ে তোলে। আলিয়াহর গুহায় নেই কোনো আধুনিকতা, নেই বৈদ্যুতিক বাতি কিংবা রান্নার ব্যবস্থা। তারপরও তাঁর আত্মতৃপ্ত মুখ দেখে মনে হয়, এখানেই আছে প্রকৃত সুখ।

সোকোত্রা দ্বীপ নিজেই এক প্রাকৃতিক বিস্ময়। এখানে এমন সব গাছপালা ও প্রাণী আছে যা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। এই বিরল পরিবেশে আলিয়াহ যেন এক প্রতীক, যিনি আধুনিকতা থেকে পালিয়ে নয়, বরং প্রকৃতিকে গ্রহণ করে নতুন এক জীবন বেছে নিয়েছেন।

তিনি জানেন না বিশ্বে কী হচ্ছে, জানেন না রাজনীতি বা প্রযুক্তির খবর।
তবে তিনি জানেন, কখন ঢেউ বিপজ্জনক হয়, কোন মৌসুমে মাছ বেশি থাকে, কোন গাছের ফল খাওয়া যায় আর কোনটি বিষাক্ত। প্রকৃতির এমন গভীর বোঝাপড়া হয়তো আমাদের বইয়ে নেই, কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতায় তা রয়েছে প্রতিদিনের বাস্তবতায়।

এই মানুষটিকে দেখে মনে হয়, পৃথিবী যতই এগিয়ে যাক, প্রকৃতির কোলে এখনো বাস করে এমন এক জীবন, যা আমাদের ভুলে যাওয়া সরলতা আর আত্মার শান্তি ফিরিয়ে দিতে পারে।

👉 এমন ব্যতিক্রমী মানুষের গল্প আরও জানতে এখনই বিজনেসটুডে২৪.কম-এর ফেসবুক পেজ ফলো করুন ও লাইক দিন।
আপনার চোখ খুলে দেবে এমন জীবনচিত্র পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।