Home First Lead আরাফাত পাহাড়ে লাখ লাখ হাজির কান্না ও ক্ষমা প্রার্থনা

আরাফাত পাহাড়ে লাখ লাখ হাজির কান্না ও ক্ষমা প্রার্থনা

ছবি সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

আরাফাত: আরাফাত পাহাড়ের উপর যখন সূর্য মধ্যগগনে, তখন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত লাখো হাজির দণ্ডায়মান দুচোখে প্রার্থনা, হৃদয়ে অনুশোচনা, কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা। হজের সবচেয়ে পবিত্র এই দিনে সৌদি আরবের তাপমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষের আত্মিক আবেশ ছিল ছায়াঘেরা প্রশান্তিময়।

চরম গরম মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ নিয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। আরাফাত অভিমুখে রাস্তায় বসানো হয়েছে কুয়াশা স্প্রে, ছায়াযুক্ত এলাকা বাড়ানো হয়েছে ৫০ হাজার বর্গমিটার পর্যন্ত। এর পাশাপাশি হজযাত্রীদের সুরক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক ও নিরাপত্তা বাহিনী।

ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা হজযাত্রী রেহমান আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, “আমি রেহমান, ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছি, খুব খুশি আজ। অনুমতির মাধ্যমে হজ হচ্ছে  এটা সবার জন্য ভালো হয়েছে।”

ছবি: সংগৃহীত

তার পাশে দাঁড়িয়ে মিসরের মারওয়া আল-সাঈদ বলছিলেন, “এই ময়দানে দাঁড়িয়ে যে অনুভব, তা ভাষায় বোঝানো যায় না। এখানে নবী করিম (সা.) দাঁড়িয়েছিলেন, আর আজ আমাদের জানানো হচ্ছে, ‘তোমাদের পাপ ক্ষমা করা হয়েছে।’ এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। চারপাশের ভিড়, কান্না আর প্রার্থনা—এই দৃশ্য শিহরণ জাগায়।”
তিনি বলেন, “নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আল্লাহর কসম করে বলছি, আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ অনুভব করছি।”

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ভারতীয় হজযাত্রী নাজিম খলিফা জানালেন তার আত্মিক অনুভব, “আমি আগে কখনো উমরাহ বা হজ করিনি। বহু কষ্ট, অর্থনৈতিক সংকট, আর চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে আজ এখানে। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘হজ হলো আরাফাত।’ আমি আজ যেন বিচার দিবসের অনুরূপ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি। সূর্য মাথার উপর, এই গরম—সবই পরীক্ষা। কিন্তু আমি চাচ্ছি জীবনের মোড় ঘুরে যাক। আল্লাহ যেন আমার দোয়া কবুল করেন।”

চলতি বছর হজে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও ছিল চোখে পড়ার মতো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা হয়, স্বাস্থ্য ট্র্যাকার দিয়ে তাপমাত্রা ও ক্লান্তির পর্যবেক্ষণ চলে। ৪০০-র বেশি কুলিং ইউনিট বসানো হয়, হাঁটার পথগুলোতে ঠান্ডা করার ব্যবস্থা ও মিস্টিং স্টেশন স্থাপন করা হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সতর্কবার্তা দিয়ে জানায়, সরাসরি সূর্যের নিচে থাকার ক্ষেত্রে ছাতা ব্যবহার করতে, পর্যাপ্ত পানি পান করতে এবং বিশ্রাম নিতে। পাশাপাশি শতাধিক মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয় তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবার জন্য।

ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় হজযাত্রীদের সেবায় নিয়োজিত করে ভাষানুযায়ী দোভাষী টিম, সচেতনতামূলক ডিজিটাল স্ক্রিন ও ২০০,০০০-র বেশি বই-পুস্তক বিতরণ করা হয়। মোবাইলে পাঠানো হয় ১ কোটি ৫০ লাখ সচেতনতার বার্তা, যাতে হজের প্রতিটি ধাপ ও করণীয় সম্পর্কে থাকে সঠিক দিকনির্দেশনা।

বিশ্ব মুসলিমের এই মিলনমেলা কেবল একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি শান্তি, ক্ষমা ও ঐক্যের বার্তা বহন করে প্রতিটি হৃদয়ে জেগে থাকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আকুলতা।

শায়খ ড. সালেহ বিন হামিদ

আরাফার খুতবা প্রদান করেন মক্কার পবিত্র মসজিদের ইমাম শায়খ ড. সালেহ বিন হামিদ। তিনি বলেন, আজকের দিনে আল্লাহ দ্বীনকে পূর্ণ করেছেন—এই উপলক্ষে তাকওয়া অবলম্বনের পাশাপাশি পরিবার, সততা, নৈতিকতা ও নামাজের গভীর আত্মিক তাৎপর্যকে জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে শেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস করা মানে তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করা, পথকে আঁকড়ে ধরা এবং ধর্মে নতুন কোনো প্রথা যুক্ত করা থেকে বিরত থাকা। নামাজ কেবল ইবাদত নয়—এটি আত্মশুদ্ধি, শৃঙ্খলা এবং আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত থাকার মাধ্যম।

খুতবায় তিনি আরও বলেন, হাজিদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সৌদি নেতৃত্ব যে ভূমিকা রেখেছে তা প্রশংসার যোগ্য। তিনি হাজিদের হজের নিয়ম মেনে চলার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন—যা কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার স্বার্থেও অপরিহার্য।

আরাফার প্রাচীন নামিরা মসজিদ, যা আব্বাসীয় আমলে নির্মিত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে সৌদি শাসকদের অধীনে ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়, বর্তমানে ১ লাখ ১০ হাজার বর্গমিটারেরও বেশি এলাকায় বিস্তৃত এবং ৩ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মুসল্লি ধারণে সক্ষম। ছয়টি মিনার, তিনটি গম্বুজ এবং ৬৪টি দরজা সমৃদ্ধ এই মসজিদে রয়েছে ১০টি প্রধান প্রবেশপথ।

চলতি বছর সৌদি ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয় নামিরা মসজিদের পেছনের আঙিনায় নতুনভাবে ১৯টি ছাউনি স্থাপন করেছে, যা তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমিয়ে আনতে সহায়ক। মাটিতে প্রতিফলন রোধকারী প্রলেপ দেওয়া হয়েছে, বসানো হয়েছে ১১৭টি কুয়াশা ছিটানো ফ্যান। এ ছাড়া আধুনিক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বায়ু পরিশোধন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় শতভাগ বাতাস দু’বার পরিবর্তন করে—ফলে হাজিরা পেয়েছেন এক নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে ইবাদতের সুযোগ।