বিশেষ ফিচার
তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: শীতের মিহি কুয়াশা ভেদ করে বাংলাদেশের আকাশে মাঝে মাঝে দেখা মেলে বিশাল ডানার এক আগন্তুকের। মাটি থেকে বহু উঁচু দিয়ে উড়ে চলা এই বিশালাকৃতির পাখিটি আমাদের দেশি কোনো চিল বা বাজপাখি নয়। এটি সুদূর হিমালয় পর্বতমালা থেকে আসা অতিথি পাখি—‘হিমালয়ান গ্রিফন ভালচার’ বা হিমালয়ী গৃধিনী। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এই পাখিটির ভূমিকা অনস্বীকার্য, অথচ এরা আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখে।
কেমন দেখতে এই বিশাল পাখি?
এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শকুনের জৌলুস দেখার মতো। এর বৈজ্ঞানিক নাম Gyps himalayensis। পূর্ণবয়স্ক একটি হিমালয়ান গ্রিফনের ওজন সাধারণত ৮ থেকে ১২ কেজি পর্যন্ত হয়। এদের ডানার বিস্তার বা ‘উইং স্প্যান’ প্রায় ৯ থেকে ১০ ফুট। গায়ের রঙ ফ্যাকাশে বালু-বাদামি বা খয়েরি। তবে এদের চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো লম্বা গলা এবং গলার গোড়ায় সাদা পালকের একটি ‘নেক-কলার’ বা বলয়। তীক্ষ্ণ বাঁকানো ঠোঁট আর শক্তিশালী নখ এদের মৃত পশুর চামড়া ছিঁড়ে খেতে সাহায্য করে।
আবাস এবং বাংলাদেশে আগমন
নাম শুনেই বোঝা যায় এদের মূল আবাসস্থল হিমালয় পর্বতমালা এবং তিব্বতীয় মালভূমি। নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান ও চীনের পার্বত্য এলাকায় এরা বসবাস করে। সাধারণত এরা হাজার হাজার ফুট উঁচুতে বাসা বাঁধে।
শীতকালে হিমালয়ের উপরিভাগে যখন প্রচণ্ড তুষারপাত শুরু হয় এবং তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে নেমে যায়, তখন খাবারের অভাব দেখা দেয়। সেই সময় খাবারের সন্ধানে এবং তুলনামূলক উষ্ণ আবহাওয়ার খোঁজে এরা দলছুট হয়ে বা ঝাঁক বেঁধে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল (পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর) এবং সিলেট অঞ্চলের দিকে চলে আসে। একে বলা হয় ‘অলটিচিউডিনাল মাইগ্রেশন’ বা উচ্চতাগত পরিযায়ন।
প্রকৃতির অকৃত্রিম বন্ধু
শকুনকে বলা হয় ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’। হিমালয়ান গ্রিফনও এর ব্যতিক্রম নয়। এরা মূলত মৃতজীবী। গরু, মহিষ বা অন্যান্য প্রাণীর মৃতদেহ খেয়ে এরা পরিবেশকে দুর্গন্ধ ও জীবাণুমুক্ত রাখে। শকুন যদি মৃতদেহ না খেত, তবে অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা ও খুরা রোগের মতো মারাত্মক সব রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ত। শকুনদের পাকস্থলী এতটাই শক্তিশালী যে, এরা মৃত প্রাণীর শরীরের যেকোনো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া হজম করে ফেলতে পারে।
কেন ওরা বিপন্ন?
এক সময় এই শকুনগুলো প্রচুর সংখ্যায় দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে আইইউসিএন (IUCN)-এর লাল তালিকায় এরা ‘প্রায় বিপন্ন’ (Near Threatened) প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। এর প্রধান কারণ গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত ব্যথানাশক ওষুধ ‘ডাইক্লোফেনাক’ ও ‘কিটোপ্রোফেন’। এই ওষুধ প্রয়োগ করা কোনো গবাদিপশু মারা যাওয়ার পর যদি শকুন তার মাংস খায়, তবে শকুনের কিডনি নষ্ট হয়ে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সেটি মারা যায়। এছাড়াও বড় গাছ কেটে ফেলা এবং খাদ্যের অভাব এদের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলেছে।
বাংলাদেশে উদ্ধার ও পুনর্বাসন
প্রতি শীতেই বাংলাদেশের বিভিন্ন লোকালয়ে ক্লান্ত ও অসুস্থ হিমালয়ান গ্রিফন আটকা পড়ার খবর পাওয়া যায়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এরা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে আর উড়তে পারে না। অনেক সময় স্থানীয়রা না বুঝে এদের ঢিল মারে বা আটক করে রাখে। তবে আশার কথা হলো, বন বিভাগ এবং আইইউসিএন-এর ‘ভালচার রেসকিউ টিম’ এসব শকুন উদ্ধার করে দিনাজপুরের সিংড়া জাতীয় উদ্যানের শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে সুস্থ করে তোলার পর বসন্তের শুরুতে এদের আবার আকাশে ডানা মেলার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
হিমালয়ান গ্রিফন কেবল একটি পাখি নয়, এটি আমাদের ইকো-সিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের এক অপরিহার্য প্রহরী। এই রাজকীয় অতিথিরা যখন আমাদের আকাশে ডানা মেলে, তখন তারা সীমান্তহীন প্রকৃতির বার্তা নিয়ে আসে। এদের রক্ষা করা কেবল বন্যপ্রাণী প্রেমীদের দায়িত্ব নয়, বরং আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থেই শকুনদের বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।










