Home আন্তর্জাতিক পাকিস্তানের হুনজা জনগোষ্ঠির দীর্ঘায়ুর রহস্য

পাকিস্তানের হুনজা জনগোষ্ঠির দীর্ঘায়ুর রহস্য

পাকিস্তানের হুনজা প্রদেশের মহিলা

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ঘেরা গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলে অবস্থিত হুনজা উপত্যকা। হিমালয়, কারাকোরাম ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার সংযোগস্থলে এই শান্ত, স্বপ্নিল উপত্যকাকে ঘিরে অসংখ্য কিংবদন্তি ও বিস্ময়ের গল্প প্রচলিত। এখানকার মানুষদের বলা হয় বিশ্বের অন্যতম সুস্থ, দীর্ঘায়ু ও সুখী জাতি যারা ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচেন বলেও দাবি করা হয়।

প্রকৃতির কোলে হুনজা জীবন

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮,২০০ ফুট উঁচু এই উপত্যকা যেন এক টুকরো স্বর্গ। চারদিকে তুষারাবৃত পাহাড়, নীলচে নদী, টেরেসভর্তি এপ্রিকট ও আখরোট গাছ, আর ছোট ছোট পাথরের ঘর, এই হলো হুনজার প্রাকৃতিক চিত্র। এখানকার মানুষদের জীবনযাপন প্রকৃতিনির্ভর, সরল ও আত্মনির্ভরশীল।

হুনজার প্রায় প্রতিটি পরিবার নিজস্ব ফলের বাগান ও ছোট কৃষিজমি চাষ করে। তারা বেশি খান তাজা ফল, সবজি, শস্য ও বাদাম। বিশেষ করে এপ্রিকট বা খুবানি তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্থানীয়দের বিশ্বাস, খুবানির তেল ও শুকনো ফলই তাদের দীর্ঘায়ুর রহস্য।

দীর্ঘায়ুর রহস্য

বহু গবেষক মনে করেন, হুনজা জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতিই তাদের দীর্ঘায়ু ও রোগমুক্ত জীবনের মূল কারণ। তারা নিয়মিত হাঁটেন, পাহাড়ে ওঠানামা করেন, শারীরিক পরিশ্রম তাদের প্রতিদিনের অংশ। খাবারে থাকে না চিনি বা প্রক্রিয়াজাত খাবার। পানীয় হিসেবে তারা খায় ঝরনার বিশুদ্ধ পানি, যা হিমবাহ থেকে আসে।

১৯৭০–এর দশকে পশ্চিমা চিকিৎসকরা যখন হুনজা অঞ্চলে গবেষণা করেন, তারা বিস্মিত হন এই দেখে যে, এখানকার মানুষের মধ্যে হৃদরোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের হার প্রায় নেই বললেই চলে।

ভাষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার আলো

হুনজা সম্প্রদায়ের মানুষ প্রধানত বুরুসো, শিনা ও ওয়াখি ভাষায় কথা বলেন। যদিও উর্দু ও ইংরেজিও অনেকেই জানেন। তাদের সংস্কৃতিতে আছে পাহাড়ি সংগীত, নাচ, আর পুরনো লোককথার ঐতিহ্য।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও হুনজা অঞ্চল পাকিস্তানের অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলের তুলনায় অনেক এগিয়ে। সাক্ষরতার হার প্রায় ৯৫ শতাংশ, যা দেশটির গড় হারের চেয়ে বহুগুণ বেশি। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষায় স্থানীয় সম্প্রদায় অত্যন্ত সচেতন, যা দক্ষিণ এশিয়ার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।

ধর্ম ও সামাজিক কাঠামো

হুনজার অধিকাংশ মানুষ ইসমাইলি শিয়া মুসলমান, যারা আধ্যাত্মিক নেতা আগা খানের অনুসারী। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে সহনশীলতা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিক সমতার ধারণা গভীরভাবে প্রোথিত। এখানকার সমাজে নারীর মর্যাদা ও অংশগ্রহণও তুলনামূলকভাবে বেশি।

পর্যটনের নবদিগন্ত

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হুনজা পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। বরফে ঢাকা রাকাপোশি ও লেডিফিঙ্গার পিক, প্রাচীন বালতিত দুর্গ, পাসু কোন, ও হুনজা নদীর রূপ—সব মিলিয়ে এটি অভিযাত্রী ও প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য।

তবে পর্যটনের বিস্তার স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিবেশে প্রভাব ফেলছে বলে উদ্বেগও আছে। অনেকেই চান, উন্নয়ন হোক টেকসই পদ্ধতিতে, যাতে প্রাচীন ঐতিহ্য নষ্ট না হয়।

সময়ের সীমানা পেরিয়ে এক জীবন্ত কিংবদন্তি

হুনজার মানুষরা যেন সময়ের বাইরে বাঁচেন। শতবর্ষ পার করা প্রবীণরা এখনো মাঠে কাজ করেন, হাঁটেন পাহাড়ি পথে, হাসিমুখে স্বাগত জানান অতিথিদের। তাদের এই উদার, পরিশ্রমী ও প্রকৃতিনির্ভর জীবনযাপন বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়—সুস্থ জীবন মানে কেবল চিকিৎসা নয়, প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য, সরলতা ও শান্তি।

হুনজা তাই কেবল একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়; এটি এক জীবন্ত দর্শন, যা শেখায়—সুখ ও দীর্ঘায়ু মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে আছে, যদি সে প্রকৃতির ছন্দে বাঁচতে জানে।