॥ মো. মামুন ইসলাম ॥
রংপুর: ১৯৭২ সালের মে মাস। নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের তখন পাঁচ মাস পেরিয়েছে।
রংপুর নগরীর কামাল কাছনা এলাকার বাসিন্দা জেনিফার আলী এলি তখন রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। ১৯৭২ সালের ১২ মে তার জীবনের এক অবিস্মরণীয় দিন। সেদিন তিনি সৌভাগ্যক্রমে জাতির পিতা ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে পেয়ে তাঁর আদর ও স্নেহধন্য হন।
সম্প্রতি এলি তার বাসভবনে বাসসের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে জানান, সে সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন মাতৃভূমি পুনর্র্নির্মাণে বঙ্গবন্ধু দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে যাচ্ছিলেন। এরই অংশ হিসেবে মে মাসে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রংপুর অঞ্চল সফরে আসেন। বিভিন্ন জেলা সফর শেষে ১০ মে রংপুর এসে তিনি সার্কিট হাউজে ওঠেন। ওই দিন তিনি রংপুরের কালেক্টরেট মাঠে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। ওই মাঠ ও আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা তখন পরিণত হয়েছিল এক জনসমুদ্রে।
বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখতে ও তাঁর ভাষণ শুনতে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী এলি সেদিন তার ক্লাসমেট ইয়াসমিনসহ অনেকের সঙ্গে রংপুরের কালেক্টরেট মাঠে গিয়েছিলেন। লাখো জনতার মধ্যে শত চেষ্টা করেও ভিড় ঠেলে তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পরে তাঁর প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হয়ে এলি তার বান্ধবী ইয়াসমিনকে বলেছিল, ’ইশ যদি একবার বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখতে পারতাম।’ কিন্তু, তিনি হাল ছাড়লেন না।
এলি জানান, পরদিন (১১ মে) তাদের সকালের শিফটে ক্লাশ ছিল। স্কুলে গিয়ে এলি জানলেন, বঙ্গবন্ধু তখনো রংপুরে সার্কিট হাউজেই আছেন। এলি তার বেশ কয়েকজন বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে স্কুল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সার্কিট হাউজের দিকে দ্রুত অগ্রসর হলেন। এসময় এলির ভয় ছিল হয়তো বা তাদেরকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
সেদিন রংপুর থেকে রাজধানী ঢাকা ফেরার সময় বঙ্গবন্ধু সার্কিট হাউজে অনেক নেতা-কর্মী ও জনতার মাঝে ছিলেন।
সার্কিট হাউজের মূল গেটে পৌঁছা মাত্রই পুলিশ এলিসহ তাদের সকলকেই আটকে দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে যেতে বলে।
বর্তমান সময়ের মতো এতো কড়াকড়ি নিরাপত্তা ব্যবস্থা তখন ছিল না। কৈশোরের দূরন্তপনাকে কাজে লাগিয়ে তারা দেয়াল টপকে সার্কিট হাউজের বারান্দায় প্রায় বঙ্গবন্ধুর কক্ষের কাছে চলে যান।
এ সময় একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই, তোমরা এখানে কী করছো?’ এলি বলেছিলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চাই।’
বারান্দার করিডোরে বেগম সাজেদা চৌধুরী তাদের থামিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘এই, তোমরা কোথায় যাও? ’ তারা তাকে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে আসার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘যাও, তিনি ওই রুমের ভেতর আছেন।’
কক্ষটির দরজা খোলা থাকায় ভেতরে উঁকি দিতেই কিশোরীরা দেখেন তখন পাইপ হাতে কোলবালিশে হেলান দিয়ে আধা শোয়া অবস্থায় থাকা বঙ্গবন্ধুকে। তিনি বললেন, ‘তোমরা কী চাও?’
কিশোরীরা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে আসার কথা জানান। এসময় বঙ্গবন্ধু রসিকতা করে তোফায়েল আহমেদকে বললেন, ‘দেখ তো তোফায়েল, বঙ্গবন্ধু কোথায়? ওরা তাঁকে দেখতে এসেছে।’
এলি জানান, ‘আমি যখন বললাম, আমরা তাকে চিনি। আপনিই তো বঙ্গবন্ধু।’ তখন বঙ্গবন্ধু হেসে আমাদের তার কাছে ডাকলেন।
এরপর বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা কে কোন ক্লাসে পড়ো? কী চাও বলো?’
এলি উত্তরে বলেন, ‘আমরা আপনার অটোগ্রাফ নেব।’
বঙ্গবন্ধু মশকরা করে বলেন, ‘অটোগ্রাফ কী?’ মেয়েরা বলেন, ‘আপনি আমাদের স্বাক্ষর দেবেন।’
এরপর বঙ্গবন্ধু এলির কাছে খাতা-কাগজ চাইলেন অটোগ্রাফ দেয়ার জন্য। কিন্তু, তারা কেউ তা দিতে পারলেন না। কারণ, তাঁরা নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, স্কুলে বই-খাতা রেখে, দেয়াল টপকে সার্কিট হাউজে প্রবেশের জন্য খাতা-পেন্সিল ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর কক্ষে এসেছিলেন।
তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু না পেয়ে এলির ডান হাত টেনে নিয়ে তাঁর হাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর দিলেন ’শেখ মুজিব’। রুমে উপস্থিত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বললেন, এখন তোমরা বাইরে যাও। বঙ্গবন্ধু অনেক দূরে যাবেন, সময় খুব কম।
এসময় বাইরে এসে আরো একবার তাঁকে কাছে থেকে দেখার আশায় কিশোরীরা অপেক্ষা করতে থাকলেন।
কিছুক্ষণ পর সাদা রংয়ের পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরা অবস্থায় ফুলের তোড়া হাতে বেরিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। আবারও সেখানে কিশোরীদেরকে দেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর হাতে ফুলের তোড়া থেকে একটি লাল গোলাপ হাসতে হাসতে ছুড়ে দিলেন। তাঁর দেয়া ফুলটি হাতে পেয়ে এলি খুশিতে আত্মহারা হন।’
এ সময় বারান্দায় রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু নেতা-কর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের শুভেচ্ছার জবাব দিতে থাকলেন।
সেখানে বারান্দাটা একটু উঁচুতে হওয়ায় সহজে কেউ কাছে যেতে না পারলেও এলি বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের পেছনে ফেলে রেলিংয়ে কসরত করে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতের কাছে চলে যান। দিতে থাকেন বিভিন্ন শ্লোগান। ‘আমার নেতা তোমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’
এসময় বঙ্গবন্ধু সেখানে উপস্থিত রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্রদের এলিকে দেখিয়ে বলেন, ‘তোরা তো ওর (এলি) সঙ্গে তো পারলি না।’
শ্লোগানরত শিক্ষার্থীদের থামিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এখন তোরা বাড়ি গিয়ে ঠিকমতো লেখাপড়া করবি।’
তখন বঙ্গবন্ধুর কাছে বারান্দার রেলিং-এ অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে কিছুটা ঝুলিয়ে থাকা অবস্থায় এলি একটার পর একটা শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন।
এসময় এলির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এখন থাম, তুই তো ঘেমে গেছিস।’ আর অন্য কাউকে তিনি বললেন, ‘এই, একটা ছবি নিয়ো আমার, ঢাকায় গিয়ে দেখাব।’
সীমাহীন আবেগ নিয়ে এলি বাসায় ফিরে ডান হাতে দেয়া বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফটি যেন মুছে না যায়, সেজন্য হাতটি ব্যবহার করে ভাত খেলেন না। হাত না ধুয়ে মায়ের হাতে খেয়ে নেয়াসহ নানান চেষ্টা সত্ত্বেও কিশোরী এলি দু’দিনের বেশি বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফটি রাখতে পারেন নি।
পরদিন বিভিন্ন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর হাত বুলিয়ে এলিকে আদর দেয়ার ছবিটি দেখেই তাঁর বান্ধবীদের অনেকেই বলেন, ‘ইশ, আমরাও যদি বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে পারতাম।’
এলি বলেন, ‘যদি সেদিন একটা কাগজ ও পেন্সিল সঙ্গে থাকতো, তাহলে আজও সযতেœ রেখে দিতে পারতাম অটোগ্রাফটি।’ বঙ্গবন্ধুর সেই অসাধারণ ব্যক্তিত্বপূর্ণ হাসি ও তাঁর ভরাট কণ্ঠের কথাগুলো এখনো এলির স্মৃতিতে অমলিন।
এলি জানান, ‘বড় হতেই আমি বুঝতে পারলাম, আমি কত বেশি ভাগ্যবতী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বয়ং আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছেন। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে জেলের বাইরে থাকার সময়গুলোতে হয়তো বা ঠিক এমনিভাবেই তিনি তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলসহ সকল সন্তানদেরকে আদর করতেন।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের নির্মম হত্যাকা- স্মরণ করে এলি বলেন, আজও আমি ব্যথিত চিত্তে ভাবি, কী করে খুনিরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারলো? সব সময় মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর হাত বুলিয়ে দেয়া সেই আদরের স্মৃতি।
এলি বলেন, তিনি ১৯৭৫ সালের আগস্টে ঢাকায় বেড়াতে যান। তিনি তখন দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলেন। এক মামাতো বোন তাঁকে জানায়, বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। আবারো বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখার প্রবল ইচ্ছে হল। এলি তাঁর জীবনে প্রথমবারের মত শাড়ি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্ট সকালে জানলেন- ইতিহাসের সেই নৃশংশতম হত্যাকা-ের খবর। তখন দীর্ঘ সময় ঢাকায় আটকে থাকার পর তিনি রংপুরে ফিরে আসেন।
রংপুরের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আলী আশরাফের সহধর্মিণী জেনিফার আলী এলি
দুই কন্যা সন্তানের জননী। কন্যাদেরকে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে ডায়াবেটিসসহ নানা ধরণের রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। ঠিকমত চিকিৎসা নিতে পারেন না। তিনি নগরীর কামাল কাছনা এলাকায় স্বামীর রেখে যাওয়া একটি সাধারণ বাড়িতে নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছেন।
এলি বলেন, ‘আমার হাতে বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফ মুছে গেলেও আমার মাথায় হাত রেখে তাঁর আদর করার ছবিটির কপি বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোসাংবাদিক পাভেল রহমান ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করে হাতে দিয়ে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছেন। এই দূর্লভ ছবিটি আমার কাছে এক অমূল্য সম্পদ। ছবিটি ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরেও ঝুলানো আছে।’
তার ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার কথা জানতে চাইলে এলি জানান- তার একটা শেষ ইচ্ছে আছে। তা হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোটবোন শেখ রেহানাকে কাছে থেকে ছুঁয়ে দেখা। এছাড়া, তাঁর চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নেই।
সূত্র: বাসস