মোহাম্মদ কাউসার:
ইসলামের ইতিহাস কেবল পুরুষের ত্যাগের ইতিহাস নয়; এখানে নারীদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনিও স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। সেই সোনালি ইতিহাসের পাতায় যার নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে, তিনি হলেন উম্মে উমারা নুসাইবা বিনতে কাব (রা.)। মদিনার আনসার বংশের ‘বনু নাজ্জার’ গোত্রে জন্ম নেওয়া এই মহীয়সী নারী ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক অকুতোভয় সৈনিক।
ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী
নুসাইবা (রা.) ছিলেন হিজরতের পূর্বে মদিনায় ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম সারির নারীদের একজন। মক্কার অদূরে পাহাড়ি উপত্যকায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ‘বায়াতে আকাবায়ে সানিয়া’র (আকাবার দ্বিতীয় বায়াত) তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। শুধু তাই নয়, ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ায় যে ‘বায়াতে রিদওয়ান’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানেও তাঁর উপস্থিতি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
ওহুদের ময়দানে নবীজির ঢাল
ইসলামের ইতিহাসে ওহুদ যুদ্ধ ছিল এক কঠিন পরীক্ষার নাম। যুদ্ধের একপর্যায়ে যখন মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয় নেমে আসে এবং সাহাবিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন, তখন নবী করিম (সা.)-এর জীবন চরম ঝুঁকির মুখে পড়ে। সেই সংকটময় মুহূর্তে যে কয়েকজন সাহাবি নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে নবীজিকে ঘিরে মানবঢাল তৈরি করেছিলেন, নুসাইবা (রা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
স্বামী ও দুই পুত্রকে নিয়ে তিনি যুদ্ধের ময়দানে এসেছিলেন। যুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছাকাছি ছিলাম। কাফেরদের চাপে যখন যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল, তখন আমিও নবীজির সুরক্ষায় নিয়োজিত সাহাবিদের সাথে যুক্ত হয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ শুরু করলাম।”
যুদ্ধ চলাকালীন কুরাইশ যোদ্ধা ইবনে কামিআ ‘মুহাম্মদ কোথায়’ বলে চিৎকার করে নবীজির দিকে তেড়ে আসছিল। তখন মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-এর সাথে নুসাইবা (রা.)-ও তাকে প্রতিহত করতে এগিয়ে যান। তিনি বলেন, “সে আমাকে দেখে কাঁধে তরবারির আঘাত করে, যাতে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। প্রচণ্ড ব্যথা সত্ত্বেও আমি হাল না ছেড়ে পাল্টা আক্রমণ করি। কিন্তু সে বর্ম পরিহিত থাকায় আমার আঘাত থেকে বেঁচে যায়।” (তবাকাতে ইবনে সাদ)
মিথ্যা নবুওয়ত দাবিদারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পরও ইসলামের জন্য তাঁর তলোয়ার কোষবদ্ধ হয়নি। খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর শাসনামলে ভণ্ড নবুওয়ত দাবিদার মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের বিরুদ্ধে তিনি আবার অস্ত্র ধরেন। এই যুদ্ধে তাঁর প্রিয় পুত্র হাবিব বিন জায়েদকে মুসাইলামা নির্মমভাবে শহীদ করে। পুত্রের শাহাদাতের সংবাদে তিনি ভেঙে না পড়ে শপথ করেন যে, মুসাইলামার মৃত্যু না দেখা পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হবেন না।
ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘উসদুল গাবাহ’-এর বর্ণনামতে, সেই যুদ্ধে তিনি অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেন। যুদ্ধ শেষে যখন তিনি ফিরেন, তখন তাঁর শরীরে ছিল ১২টি তরবারি ও বর্শার আঘাত এবং তিনি একটি হাত হারিয়েছিলেন। তবুও ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন রাখতে তিনি ছিলেন অবিচল।
বিদায় ও জান্নাতুল বাকি
ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই সাহাবি ১৩ হিজরিতে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। মদিনার জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়।
পবিত্র জুমার এই দিনে আমরা মহান আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন জান্নাতে এই মহীয়সী নারীর মর্যাদা আরও বুলন্দ করেন এবং আমাদের মা-বোনদের ইসলামের পথে এমন নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার তৌফিক দান করেন। আমিন।










