ব্রিটিশ ভারতে ছাতা ছিল বড়লোকের বিলাস সামগ্রী। মাথা আগলানোর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গীটিকে কিনতে বিস্তর গাঁটের কড়ি খসাতেন ধনীরা। সাহেব-মেমদের মাথা আগলে রাখত গোলপানা নিঁখুত কারুকাজ করা ছাতা। আর বাঙালি বাবুরা নিতেন বিশাল পরিধির কাপড়ে তৈরি ঢাউস ছাতা, চওড়া বাঁট। বাবুর মাথায় ছাতা ধরার আলাদা ভৃত্য থাকত। ছাতার আকার বুঝিয়ে দিত ছত্রধারীর সামাজিক অবস্থান। ছাতা বইবার জন্য আলাদা ভৃত্য রাখা হত। যাদের সে ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু ছাতা কিনে সাহেবিয়ানা করার ষোলোআনা সাধ ছিল তাঁরা আবার ছাতাওয়ালাদের পরিষেবা নিতেন। ছাতা বইবার জন্য ভাড়া খাটতেন যে ‘ছাতাবাহক’রা তাঁদের আড্ডা ছিল পুরনোর কলকাতার অলিগলিতে। পোদ্দার কোর্টে এমনই ছাতাবাহকদের আস্তানা ছিল এবং সেই এলাকার নাম ছাতাওয়ালা গলি।
উনিশ শতকের কলকাতায় ছাতা ছিল সর্বসাধারণের নাগালে বাইরে। রাস্তাঘাটে চোখে পড়ত পালকি চড়ে যাচ্ছেন সাহেব, আর ছাতাবরদার তাঁর মাথায় ধরে আছেন গোলাকার ছাতা। এই গোল আকারের জন্য সাহেবরা বলতেন ‘রাউন্ডেল’ এবং ছাতাবরদাদের বলা হতো ‘রাউন্ডেল-বয়’। তবে সাধারণ কেরানিরাও যে বড়লোকি চালে ভাসত না তা নয়। তবে গোল ছাতা নাকি কেবল সমাজের সম্মানীয়, উচ্চবিত্তরাই ব্যবহার করতে পারত। আর বাকিদের জন্য বরাদ্দ ছিল চৌকাকার ছাতা। ১৮৭৫-’৭৬ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস-এর বিখ্যাত ভারত ভ্রমণের সময় রাজঅতিথিদের মাথায় ধরা হত সেইসব গোলাকার ছাতা ‘রাজছত্র’।
ছাতা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। উনিশ শতকের কলকাতায় সংস্কৃত কলেজের কয়েকজন ছাত্র ও অধ্যাপকরা বিশাল কালো গোল ছাতা মাথায় দিতেন। বিদ্যাসাগরের ছাত্রবেলায় কলেজের অধ্যাপক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের বিশাল আট-নয় হাত লম্বা দণ্ডযুক্ত দশ-বারো হাত পরিধির ছাতা বইবার জন্যই কয়েকজন ভৃত্য ছিল। সেই ছাতা ছিল তালপাতার আর দণ্ড ছিল বাঁশের তৈরি। সেই সময় বিদেশি ছাতা কেনার ক্ষমতা সকলের ছিল না। কিন্তু বাবুয়ানির জন্য তালপাতা, বাঁশ ইত্যাদি দিয়েই তৈরি করে নেওয়া হত ছাতা।
১৮৫২ সালে স্যামুয়েল ফক্স ছাতা তৈরি করেন হালকা সরু রড দিয়ে। সোনা, রুপো, চামড়া, শিং, বেত ও হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি হত তার হাতল। দেড় মিটার লম্বা হাতলওয়ালা একটি ছাতার গড় ওজন হত আনুমানিক চার-পাঁচ কেজি। লন্ডনে সেই সময় খুব বৃষ্টি হত। তাই নিত্যনতুন ডিজাইনের ছাতা তৈরি হত সেই সময়। ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল যে যে দেশে, সেখানেও রফতানি করা হত সেই ছাতা। কলকাতায় এইসব ছাতা আমদানি শুরু হয় সেই সময়। সেই ছাতা কিনতেন অভিজাতরাই। হাতির দাঁত বা সোনা-রুপোর বাঁটের ছাতা কেনার সাধ্য মধ্যবিত্তদের ছিল না।
কলকাতায় প্রথম ছাতা তৈরি হয় ১৮৮২ সালে। ২৬ নং বেনিয়াটোলা লেনে নিজের বাড়িতেই প্রথম ছাতা তৈরি করেন মহেন্দ্রলাল দত্ত। ছাতা তৈরিকেই বাঙালির কুটির শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান সেই সময়। ছাতার বাজার তৈরি হয় গড়িয়াহাটে।
শহরের বাজার দেশি ছাতায় ভরে যায়। ফলে আমদানি করা ছাতার চাহিদা কমতে থাকে। সমাজের মুষ্ঠিমেয় মানুষের ব্যবহারযোগ্য বস্তু থেকে উনিশ শতকের শেষার্ধে ছাতার সর্বজনীন জনপ্রিয়তার একটা ছবি তৈরি হয় শহরজুড়ে। শরৎকুমারী চৌধুরানির ‘স্বায়ত্ত সুখ’ গল্পেও এর উল্লেখ পাওয়া গেছে। সেখানে ১৫ টাকা মাস মাইনের কেরানির বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তালিকায় চার জোড়া ধুতি, দু’জোড়া জুতো, দু’টি উড়নি, চারটি পিরানের পাশে একটি ছাতাও জায়গা করে নিয়েছে। দাম ধরা হয়েছে ১ টাকা। এইভাবেই বিদেশি ছাতার জায়গায় দিশি ছাতা ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে ছাপোষা বাঙালির অন্দরমহলেও। কালো ঢাউস ছাতার জায়গায় শৌখিন ছাতা ওঠে আমজনতার হাতে। বিলাসদ্রব্য থেকে ছাতার সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় আমজনতার।
সূত্র: দি ওয়াল