বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, বাকৃবি: গত এক দশকে বাংলাদেশের মিঠাপানির মাছ চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছে পাঙ্গাস। বিশেষ করে ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও ভালুকা উপজেলা আজ দেশের ‘পাঙ্গাস হাব’ হিসেবে স্বীকৃত। স্বল্পমূল্যের প্রোটিন সরবরাহ এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের এই প্রধান স্তম্ভটি এখন এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ ‘ব্যাসিলারি নেক্রোসিস অব পাঙ্গাস’ এই অঞ্চলে ‘নীরব ঘাতক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই রোগের প্রধান কারণ Edwardsiella ictaluri নামক একটি গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া। এটি মূলত মাছের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ—লিভার (যকৃৎ), কিডনি (বৃক্ক) ও প্লীহাকে আক্রমণ করে কোষ ধ্বংস করে ফেলে।
ভয়াবহ দিকটি হলো, আক্রান্ত মাছের বাইরে অনেক সময় কোনো ক্ষত বা দাগ দেখা যায় না। কিন্তু পেটের ভেতর অঙ্গগুলো দ্রুত পচে যেতে থাকে। ফলে খামারিরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণ মাছ মারা যেতে শুরু করে।
সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলের বিভিন্ন খামারে আক্রান্ত মাছ পরীক্ষা করে দেখা গেছে: মাছের কিডনিতে অসংখ্য সাদা রঙের ছোট ছোট গুটি বা নডিউল। লিভার অস্বাভাবিক ফুলে যাওয়া এবং বিবর্ণ হয়ে যাওয়া।গলব্লাডার বা পিত্তথলি বড় হয়ে কালচে রঙ ধারণ করা।
আন্তর্জাতিক গবেষণার সাথে ত্রিশাল-ভালুকার এই লক্ষণগুলোর হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে, যা বিজ্ঞানীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগ নিয়ন্ত্রণে না আনলে ৩০% থেকে ৭০% পর্যন্ত মাছ মারা যেতে পারে। এর ফলে:
উৎপাদন বিপর্যয়: কোটি কোটি টাকার সরাসরি লোকসান।
বাজার অস্থিরতা: বাজারে পাঙ্গাসের সরবরাহ কমে গেলে সাধারণ মানুষের আমিষের দামে প্রভাব পড়বে।
কর্মসংস্থান: ফিড মিল, হ্যাচারি এবং পরিবহনের সাথে যুক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এই মহামারি ঠেকাতে খামারিদের কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে:
পানির মান রক্ষা: অ্যামোনিয়া (NH₃) ও নাইট্রাইট (NO₂) নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেন (DO) নিশ্চিত করা।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: খাবারে ভিটামিন সি, ই, জিঙ্ক ও উচ্চমানের প্রোবায়োটিক মেশানো।
সতর্কতা: খামারের তলায় জমা হওয়া জৈব বর্জ্য বা স্লাজ অপসারণ করা এবং হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তন হলে বাড়তি নজরদারি।
ল্যাব পরীক্ষা: ঢালাওভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করে কালচার বা PCR টেস্টের মাধ্যমে রোগ নিশ্চিত হওয়া।
ব্যাসিলারি নেক্রোসিস কেবল একটি সাধারণ রোগ নয়, এটি পাঙ্গাস শিল্পের জন্য একটি বড় ধরনের সংকেত। এখনই যদি খামারি, হ্যাচারি মালিক ও মৎস্য বিভাগ সমন্বিত পদক্ষেপ না নেয়, তবে গত এক দশকের এই সাফল্য ম্লান হয়ে যেতে পারে।
বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ এবং সচেতনতাই পারে এই ‘নীরব ঘাতক’ থেকে দেশের পাঙ্গাস শিল্পকে রক্ষা করতে।










