Home ক্যারিয়ার সিলেটের তরুণ প্রজন্মের চোখে বিদেশের হাতছানি

সিলেটের তরুণ প্রজন্মের চোখে বিদেশের হাতছানি

ছবি: এআই

স্বপ্নের সীমানা যখন আটলান্টিক পাড়ে

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, সিলেট: সিলেটের হাওর, পাহাড় আর চা বাগানের মায়া ছাপিয়ে এখানকার তরুণদের চোখে এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। তবে সেই স্বপ্নের বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে বিদেশের মাটি। উচ্চশিক্ষা, উন্নত জীবনমান কিংবা পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সিলেট অঞ্চলের তরুণ-তরুণীদের বড় একটি অংশ এখন দেশান্তরী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর।

একটা সময় ছিল যখন সিলেট থেকে মানুষ কেবল রুটি-রুজির সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্য বা লন্ডনে পাড়ি দিত। কিন্তু বর্তমান চিত্র ভিন্ন। এখনকার তরুণরা যাচ্ছে ডিগ্রি আর গ্লোবাল ক্যারিয়ারের জন্য। বিশেষ করে এইচএসসি বা স্নাতক শেষ করার পর ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মূল লক্ষ্য।

ছবি: এআই

সিলেট নগরীর চৌহাট্টা বা জিন্দাবাজার এলাকায় ঘুরলে দেখা যায় আইইএলটিএস (IELTS) কোচিং সেন্টারগুলোর উপচে পড়া ভিড়। স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী সায়মন আহমেদ জানান, “দেশে ভালো ক্যারিয়ার গড়া এখন অনেক প্রতিযোগিতামূলক। তার চেয়ে বাইরে থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসা বা সেখানেই সেটল হওয়া অনেক বেশি নিরাপদ মনে হচ্ছে।”

একই কোচিং সেন্টারের সামনে কথা হয় জান্নাতুল ফেরদৌসের সাথে। তিনি জানান, “আমার অনেক বান্ধবী অলরেডি ইউকে চলে গেছে। তাদের লাইফস্টাইল দেখে এখন মনে হচ্ছে, দেশে বসে সময় নষ্ট করার চেয়ে দ্রুত প্রসেসিং করে বাইরে চলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।”

সিলেটের যেকোনো আড্ডায়—সেটা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বর হোক কিংবা জিন্দাবাজারের কোনো ক্যাফে, বিদেশে যাওয়ার আলোচনা এখন অবধারিত। আড্ডায় এখন শেয়ার করা হয় কোন দেশের ভিসা প্রসেসিং সহজ, কোন ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ বেশি বা আইইএলটিএসে ভালো করার কৌশল। যারা ইতিমধ্যে চলে গেছেন, তাদের সাথে মেসেঞ্জারে ভিডিও কলে কথা বলে বর্তমান অবস্থা এবং পার্ট-টাইম জবের সুযোগ সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া এখন নিত্যদিনের ঘটনা।

সিলেটের সামাজিক কাঠামোতে ‘লন্ডনি’ বা প্রবাসী হওয়ার একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। অনেক পরিবারই চায় তাদের সন্তান অন্তত একবারের জন্য হলেও বিদেশে যাক। এ বিষয়ে এক অভিভাবক আলহাজ্ব রফিক উদ্দিন বলেন, “সিলেটের মাটি ও মানুষের সাথে বিদেশের একটা নাড়ির টান আছে। আমার বড় ছেলে লন্ডনে আছে, ছোটটাকেও পাঠাতে চাই। দেশে কর্মসংস্থানের যে অবস্থা, তাতে বাইরে পাঠানোকেই আমরা ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা মনে করি।”

অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের বড় ভাই বা বাবার পথ ধরে ছোটরাও পাড়ি দিচ্ছে। এই প্রবাসীবান্ধব মানসিকতা তরুণদের দেশের ভেতরে উদ্যোগী হওয়ার চেয়ে বাইরে যাওয়ার প্রতি বেশি আগ্রহী করে তুলছে।

বিদেশের স্বপ্ন যতটা রঙিন, প্রস্তুতি ততটাই কঠিন। তরুণরা এখন কঠোর পরিশ্রম করছে। ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি এখন জাপানি বা জার্মান ভাষাও শিখছে অনেক তরুণ। কেবল পড়াশোনা নয়, বাইরে গিয়ে যেন কাজ পাওয়া যায় সেজন্য ড্রাইভিং, গ্রাফিক ডিজাইন বা শেফের কাজ শিখছে অনেকেই।

মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিশাল অংকের ব্যাংক সলভেন্সি। তবুও জায়গা-জমি বিক্রি করে কিংবা লোন নিয়ে হলেও এই ঝুঁকি নিচ্ছেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে একজন মা হেনা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, “ছেলেটা যাওয়ার জন্য পাগল। জমি বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করছি। বুক ফেটে যায় যখন ভাবি চোখের আড়াল হয়ে যাবে, কিন্তু তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাদের হাসিমুখে এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে হয়।”

অতিরিক্ত বিদেশমুখী প্রবণতার কারণে সিলেট অঞ্চল থেকে মেধাবী তরুণদের হারানো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন শিক্ষাবিদ ও সচেতন মহল। তাদের মতে, মেধাবী তরুণরা যদি সবাই দেশ ছেড়ে চলে যায়, তবে স্থানীয় উন্নয়ন ও নেতৃত্ব সংকটে পড়বে সিলেট।

সিলেটের তরুণদের এই বিদেশ যাত্রার স্বপ্ন একদিকে যেমন ব্যক্তিগত সচ্ছলতা আর বিশ্ব নাগরিক হওয়ার সুযোগ তৈরি করছে, অন্যদিকে দেশের মেধা সম্পদ হারানোর ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। তবে বিশ্বায়নের যুগে উন্নত শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা আর উন্নত জীবনের স্বপ্নকে দমিয়ে রাখা কঠিন—এটিই বর্তমানের রূঢ় বাস্তবতা।