বাংলা ভাষায় “সরফরাজি চাল” বা “সরফরাজি করা” প্রবাদটি অত্যন্ত পরিচিত। কোনো বিষয়ে অনধিকার চর্চা করা, অযাচিত পাণ্ডিত্য দেখানো বা অন্যের ওপর অনর্থক মাতব্বরি করাকে আমরা এই শব্দবন্ধ দিয়ে প্রকাশ করি। কিন্তু এই নেতিবাচক অর্থবহ প্রবাদটির মূলে রয়েছেন বাংলার এক স্বল্পকালীন নবাব— সরফরাজ খান।
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
নবাব সরফরাজ খান ছিলেন বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন মুহম্মদ খানের পুত্র এবং নবাব মুর্শিদকুলি খানের দৌহিত্র। ১৭৩৯ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি বাংলার মসনদে বসেন। তাঁর শাসনকাল ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত (মাত্র ১৩ মাস)। তিনি ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক ও অমায়িক হলেও প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে ছিলেন অদূরদর্শী এবং কিছুটা উদ্ধত।
২. কেন এই প্রবাদটির উৎপত্তি?
সরফরাজ খানের শাসনকালে তাঁর অদূরদর্শিতা এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার কারণে “সরফরাজি” শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এর পেছনে মূলত তিনটি প্রধান কারণ কাজ করেছে:
অহেতুক বিলাসিতা ও অহংকার: সরফরাজ খান নিজের ক্ষমতা ও পদের গরিমা প্রদর্শনে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। প্রজাদের কল্যাণ বা রাজ্যের নিরাপত্তার চেয়ে নিজের আভিজাত্য বা “চাল-চলন” জাহির করাকেই তিনি প্রাধান্য দিতেন।
অযাচিত কর্তৃত্ব প্রদর্শন: কোনো বিষয়ে গভীর জ্ঞান বা যোগ্যতা না থাকলেও তিনি সব কাজে হস্তক্ষেপ করতেন এবং নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন। এই “নিজেকে বড় মনে করা” থেকেই মূলত “সরফরাজি করা” বাগধারাটির জন্ম।
গিরিয়ার যুদ্ধ ও পতন: তাঁর এই দাম্ভিকতা এবং রাজপরিবারের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অবজ্ঞার ফলে বিহারের নায়েব নাযিম আলিবর্দী খান বিদ্রোহ করেন। ১৭৪০ সালে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খান পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর এই ব্যর্থতা মানুষের কাছে বিদ্রূপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
৩. অর্থের বিবর্তন
সময়ের সাথে সাথে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হারিয়ে গেলেও শব্দটি জনমানসে গেঁথে যায়। বর্তমানে কেউ যদি নিজের যোগ্যতার বাইরে গিয়ে বেশি মাতব্বরি করে, তবে মানুষ তাকে বিদ্রূপ করে বলে— “বেশি সরফরাজি দেখিও না” অথবা “ওর সব সময় সরফরাজি চাল।”










