নতুন শ্রম আইনের কড়াকড়ি
মাহবুবুল হক, মাস্কাট: ওমান সরকার তাদের জাতীয় শ্রম নীতির অংশ হিসেবে রাজকীয় ডিক্রি ৫৩/২০২৩-এর মাধ্যমে নতুন শ্রম আইন কার্যকর করেছে। এই আইনের মূল লক্ষ্য ‘ওমানাইজেশন’ বা কর্মসংস্থানে স্থানীয় নাগরিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া। ওমানের বেসরকারি খাতে স্থানীয়দের নিয়োগ বাধ্যতামূলক করায় দেশটিতে অবস্থানরত বিশাল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
দেশটির বৃহত্তম প্রবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশিরা দীর্ঘকাল ধরে ওমানের নির্মাণ, ব্যবসা, সেবা এবং কৃষি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে নতুন এই আইনের কঠোর বিধিনিষেধের ফলে তাদের কর্মসংস্থান ও ব্যবসায়িক ভবিষ্যৎ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব ও বিশ্লেষণ
১. চাকরির বাজার সংকুচিত হওয়া:
নতুন আইনে ওমানের শ্রমমন্ত্রীকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি নির্দিষ্ট কিছু পেশায় প্রবাসীদের নিষিদ্ধ করে শুধুমাত্র ওমানিদের নিয়োগের নির্দেশ দিতে পারবেন। এর ফলে ডাইভিং, ক্যাশিয়ার, সেলসম্যান কিংবা অফিসের প্রশাসনিক পদের মতো চাকরিগুলো—যেখানে অনেক বাংলাদেশি কর্মরত আছেন—তা হাতছাড়া হওয়ার প্রবল ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ‘রিপ্লেসমেন্ট’ বা প্রতিস্থাপন নীতির কারণে প্রবাসীদের জায়গায় স্থানীয়দের বসানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
২. বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি চাপ:
ওমানে অনেক বাংলাদেশি উদ্যোক্তা আছেন যারা ছোট ও মাঝারি ব্যবসা পরিচালনা করেন এবং সেখানে দেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দেন। নতুন আইন অনুযায়ী, ২৫ বা ততোধিক কর্মী থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ওমানি কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। একইসঙ্গে ওমানিদের নেতৃত্বের পদে (Leadership Roles) বসানোর জন্য প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্থানীয় কর্মীদের উচ্চ বেতন এবং প্রশিক্ষণের খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়বে। এতে ব্যবসার পরিচালন ব্যয় (Operational Cost) বেড়ে যাবে, যা অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারে।
৩. জরিমানা ও ভিসা নবায়নে জটিলতা:
আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ওমানাইজেশনের লক্ষ্যমাত্রা বা কোটা পূরণ না করলে প্রতিটি ওমানি কর্মীর বিপরীতে নিয়োগকর্তাকে মোটা অংকের জরিমানা গুনতে হবে। পুনরাবৃত্তি হলে জরিমানার পরিমাণ হবে দ্বিগুণ। অনেক বাংলাদেশি নিয়োগকর্তা বা স্পন্সর (আরবাব) এই জরিমানার ভয়ে বাংলাদেশি কর্মীদের ভিসা নবায়ন বা নতুন ভিসা দিতে অনীহা প্রকাশ করতে পারেন। এতে অবৈধ হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বেন হাজারো কর্মী।
আইনের মূল বিষয় ও বিশেষজ্ঞদের মত
সম্প্রতি টাইমস অফ ওমান-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আইনজীবী ড. মোহাম্মদ ইব্রাহিম আল-জাদজালি জানান, নতুন আইনে নিয়োগকর্তাদের ওমানি কর্মীদের জন্য বিশেষ রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ এবং বার্ষিক পরিকল্পনা শ্রম মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। তিনি সতর্ক করে বলেন, “এই আইনটি কেবল নির্দেশনাই নয়, বরং জরিমানা এবং রাষ্ট্রীয় সহায়তার এক সমন্বিত ব্যবস্থা, যা বেসরকারি খাতে ওমানিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ডিজাইন করা হয়েছে।”
ওমানের এই নতুন বাস্তবতা মেনে নিয়েই প্রবাসী বাংলাদেশিদের চলতে হবে। অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমলেও দক্ষ এবং কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীদের চাহিদা হয়তো বজায় থাকবে। তবে সাধারণ শ্রমবাজার ও ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের জন্য প্রতিযোগিতা যে তীব্রতর হবে এবং টিকে থাকা কঠিন হবে, তা নতুন এই আইনের ধারাগুলো থেকেই স্পষ্ট।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উচিত ওমানের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা এবং কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশি কর্মীদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করা।
👉 আপনার পরিচিত কেউ কি ওমানে থাকেন?
ওমানের এই নতুন শ্রম আইন হাজারো প্রবাসীর ভাগ্য বদলে দিতে পারে। আপনার পরিচিত প্রবাসী ভাই-বোনদের সচেতন করতে প্রতিবেদনটি এখনই শেয়ার করুন।










