Home Third Lead সৌদি আরবে কাফালা সিস্টেমের অবসান: বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বাধীনতার নতুন অধ্যায়

সৌদি আরবে কাফালা সিস্টেমের অবসান: বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বাধীনতার নতুন অধ্যায়

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: সাত দশকের পুরনো ‘কাফালা’ বা স্পনসরশিপ সিস্টেম বাতিল করে সৌদি আরব শ্রমনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। নতুন এই সংস্কারে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বিদেশি শ্রমিকের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী সরাসরি উপকৃত হবেন। সৌদি সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, কাফালা ব্যবস্থার পরিবর্তে এখন থেকে শ্রমিকদের কর্মসম্পর্ক চুক্তিভিত্তিকভাবে পরিচালিত হবে, যা শ্রমিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা বহুগুণে বৃদ্ধি করবে।
কী ছিল কাফালা সিস্টেম

‘কাফালা’ (স্পনসরশিপ) ব্যবস্থায় বিদেশি শ্রমিকদের ভিসা, বসবাস, চাকরি পরিবর্তন এবং দেশ ত্যাগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল নিয়োগদাতা বা ‘কাফিল’-এর হাতে। অর্থাৎ শ্রমিকদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনের প্রায় সব সিদ্ধান্তই নির্ভর করত নিয়োগদাতার অনুমতির ওপর। মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবস্থাকে শোষণমূলক ও দাসত্বের রূপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল।

নতুন শ্রম সংস্কার: শ্রমিকদের জন্য কী পরিবর্তন আনল

সৌদি মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নতুন সংস্কারে শ্রম সম্পর্ক ‘চুক্তিভিত্তিক’ হবে। এখন শ্রমিকরা—

  • নির্ধারিত সময় শেষে বা চুক্তি অনুযায়ী নোটিশ দিয়ে নিয়োগদাতার অনুমতি ছাড়াই চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন,
  • দেশ ছাড়ার সময় আর স্পনসরের অনুমতি লাগবে না,
  • শ্রম আদালত ও অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় সহজে অভিযোগ জানাতে পারবেন,
  • সব শ্রম চুক্তি এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘কিউয়া’-তে (Qiwa) নিবন্ধিত হবে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।

এই পরিবর্তন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ সংস্কার কর্মসূচির অংশ, যার লক্ষ্য আধুনিক শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং শ্রমিক অধিকার রক্ষা করা।

বাংলাদেশের জন্য প্রভাব

সৌদি আরব বর্তমানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় কর্মগন্তব্য দেশ। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন, যারা প্রতিবছর দেশে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স পাঠান।

কাফালা ব্যবস্থার অবসানের ফলে—

  • বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মস্থল পরিবর্তনের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পাবে,
  • বেতন আটকে রাখা বা পাসপোর্ট জব্দের মতো অনিয়ম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে,
  • শ্রম আদালতে অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়া সহজ হবে,
  • শ্রমিকরা কাজের পরিবেশ ও সুযোগের ভিত্তিতে নিজের পেশাগত ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারবেন।

ঢাকায় প্রবাসীকল্যাণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরবের এই পরিবর্তন বাংলাদেশের রেমিট্যান্স অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ এতে শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা, দক্ষতা মূল্যায়ন ও কর্মচুক্তির স্বচ্ছতা বাড়বে।

চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবায়ন

তবে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে, আইনি সংস্কার হলেও বাস্তব পর্যায়ে প্রয়োগই হবে আসল পরীক্ষা। অনেক নিয়োগদাতা এখনো পুরনো কাঠামোর প্রভাব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসেননি। কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ ফি আদায় ও চুক্তি-বদলের অভিযোগও অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সৌদি আরবের এই সংস্কারের ফলে নতুন শ্রম চুক্তি সই, তথ্য যাচাই এবং আইনি সহায়তা প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা হবে। বাংলাদেশ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার, অভিযোগ নিষ্পত্তি ও আইনি সুরক্ষায় সচেতনতা কর্মসূচিও চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।

সৌদি আরবের কাফালা সিস্টেমের অবসান শুধু শ্রমিক অধিকার পুনর্গঠনের সূচনা নয়, বরং বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের জন্যও এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এই সংস্কার সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা আরও নিরাপদ, স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে পারবেন। একই সঙ্গে এটি দুই দেশের অর্থনৈতিক ও মানবসম্পর্ককেও আরও সুদৃঢ় করবে।