মধ্যযুগে বাঙালি কারিগরদের খ্যাতি ছিল সমস্ত ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে। তাঁদের বানানো উন্নত মানের সব জিনিসপত্র বণিকদের মাধ্যমে সারা বিশ্বে পাড়ি দিত। বাঙালি কারিগরদের কদর করতেন মুঘল সম্রাটরাও। জনার্দন কর্মকার ছিলেন বাংলার এক দক্ষ কামার। তাঁর বানানো এক ভয়ংকর কামানের নাম ‘বাচ্চাওয়ালি তোপ’। লোকমুখে শোনা যায়, সেই কামান দাগা হয়েছিল মাত্র একবারই। কিন্তু সেই তোপ দাগার শব্দ এতটাই প্রবল ছিল যে আশেপাশের বহু মহিলার গর্ভপাত ঘটে যায় সেই আওয়াজে। তারপর সেই কামান আর ব্যবহার করা হয়নি। ‘বাচ্চাওয়ালি’ নামটা নাকি এসেছে এভাবেই। বাংলায় তখন পৃথিবীর সেরা সেরা কামান তৈরি করতেন লোহার মিস্ত্রিরা। বিদেশেও রপ্তানি করা হত সেই সব কামান।
ঢাকার বাসিন্দা প্রবাদপ্রতিম লোহার কারিগর জনার্দন আরেকটি বিখ্যাত কামান বানিয়েছিলেন। তার নাম ‘জাহানকোষা’। মুঘল যুগের শেষ ভাগে এবং বাংলার নবাবি আমলের যুদ্ধাস্ত্র যে কত উন্নত মানের ছিল, এই তোপ তার প্রমাণ। ‘জাহানকোষা’ শব্দের অর্থ হল ‘পৃথিবী ধ্বংসকারী’। এই কামানের গায়ে ফার্সি ভাষায় খোদাই করা আছে, ১০৪৭ হিজরির জমাদিয়স সানি মাস, অর্থাৎ ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে বাংলার সুবাহ্দার ইসলাম খাঁর প্রশাসনিক আমলে জাহাঙ্গিরনগরে দারোগা শের মহম্মদ এবং হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে এই জাহানকোষা তোপ নির্মাণ করেন ঢাকার জনার্দন কর্মকার।
কামানটি বানানো হয়েছে তামা, লোহা, রুপো, সিসা, দস্তা, সোনা, পারদ, টিন এই অষ্টধাতু দিয়ে। যার ফলে এই তোপে জং পড়েনি এখনও। জাহানকোষা তোপ দৈর্ঘ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার এবং ওজন সাত টনেরও বেশি। একবার গোলা দাগার জন্য ১৭ কিলোগ্রাম বারুদের প্রয়োজন হত। বেশ কয়েক এই কিলোমিটার দূরের শত্রুকেও জোরদার আঘাত করা যেত এই কামান দেগে।
বাংলার প্রথম নবার মুর্শিদকুলি খাঁ নিজের রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে আনেন মুর্শিদাবাদে। তখন এই কামানটিকেও মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয়। বাংলার নবাবরা মুর্শিদাবাদে যে বিখ্যাত তোপখানা বা অস্ত্রাগার স্থাপন করেছিলেন, সেখানেই রাখা থাকত এই জাহানকোষা তোপ। অনেক পরে জাহানকোষা কামানটিকে পাওয়া যায় একটি অশ্বথ গাছের নিচে, শিকড়ে আটকে থাকা অবস্থায়। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার উদ্যোগে সেটিকে উঠিয়ে নিয়ে রাখা হয় মুর্শিদাবাদের তোপখানা এলাকায়। এখন সেখানেই রাখা আছে ওটি। পর্যটকরা গিয়ে কামানটিকে দেখে আসতে পারেন।
-সূত্র বঙ্গদর্শণ