Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য সোনার প্রাসাদের রাজপুত্র, ঐশ্বর্য ও বিলাসের দিনগুলো

সোনার প্রাসাদের রাজপুত্র, ঐশ্বর্য ও বিলাসের দিনগুলো

ছবি: এ আই
তারিক-উল-ইসলাম: হায়দরাবাদের রাজকীয় ইতিহাসে মুকাররম জাহের নামটি উজ্জ্বল হলেও তার চারপাশে একধরনের রহস্য ও মোহ কাজ করে। তিনি ছিলেন এমন এক উত্তরাধিকারী, যার জন্মই হয়েছিল সোনায় মোড়ানো জীবনের ভেতর। পৃথিবীর ধনীতম রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁর জীবনযাত্রা ছিল এক বিরল স্বপ্নের মতো—যেখানে প্রাসাদের ছাদে ঝুলত হীরার ঝাড়বাতি, আর রাজসভায় বেজে উঠত সোনালি ঘন্টার শব্দ।

বিশ্বজুড়ে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে দেশগুলো দারিদ্র্যের মুখোমুখি, তখন হায়দরাবাদের নিজাম পরিবার ছিল অগাধ সম্পদের মালিক। মুকাররম জাহের দাদু মির ওসমান আলি খানকে ১৯৩৭ সালে টাইম ম্যাগাজিন ঘোষণা করেছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে। সেই সম্পদের উত্তরাধিকার পান মুকাররম জাহ—অমূল্য হীরা, সোনা, জমি, শিল্পকর্ম ও প্রাসাদে পূর্ণ এক সাম্রাজ্যের মালিকানা।

তাঁর রাজকীয় জীবনের কেন্দ্র ছিল দুটি প্রতীকী প্রাসাদ—চৌমহল্লা প্যালেস ও ফলকনুমা প্যালেস। চৌমহল্লা প্যালেস ছিল রাজসভা ও প্রশাসনের আসন, আর ফলকনুমা ছিল রাজকীয় বিলাসের প্রতীক। ফলকনুমা প্যালেসের স্থাপত্য ছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও ভারতীয় শৈলীর এক অনন্য মিশ্রণ। সেখানকার সোনালি ছাদ, রূপার আসবাব, ইতালীয় মার্বেল মেঝে আর ঝলমলে ঝাড়বাতি যেন এক সম্রাটের রুচির প্রমাণ বহন করত। কথিত আছে, এই প্রাসাদের প্রধান ঝাড়বাতিটিই এত ভারী ছিল যে সেটি ঝুলানোর আগে ছাদ মজবুত করতে হয়েছিল বিশেষ ইস্পাত কাঠামো দিয়ে।

মুকাররম জাহের শখ ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি বিলাসবহুল গাড়ির প্রতি ছিলেন অনুরাগী। তাঁর গ্যারেজে ছিল রোলস-রয়েস, মার্সিডিজ, বেন্টলি, এমনকি কাস্টম-মেড রাজকীয় ক্যারেজও। ঘড়ি ও অস্ত্র সংগ্রহেও তিনি ছিলেন আগ্রহী। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল শত শত দামী হাতঘড়ি, প্রাচীন তলোয়ার, রত্নখচিত বন্দুক ও সোনার আস্তরণ দেওয়া রাজদণ্ড।

তাঁর জীবনের প্রতিটি উৎসব ছিল চোখধাঁধানো। হায়দরাবাদের রাজপ্রাসাদে নববর্ষ কিংবা ঈদের উৎসব মানেই ছিল সপ্তাহজুড়ে রাজকীয় ভোজ, আতশবাজি, সংগীত ও নৃত্য অনুষ্ঠান। অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত থাকতেন দেশি-বিদেশি রাজা, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও শিল্পী। রাজপ্রাসাদের দরবারে বেজে উঠত উর্দু গজল, কাওয়ালি আর রাজসঙ্গীতের মূর্ছনা।

তবে এই ঐশ্বর্য শুধুই ভোগবিলাসে সীমাবদ্ধ ছিল না। মুকাররম জাহ ছিলেন শিল্প ও সংস্কৃতিপ্রেমী। তিনি নিজাম রাজবংশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হায়দরাবাদের জাদুঘর, মসজিদ ও প্রাসাদ সংরক্ষণে উদ্যোগী হন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বহু ঐতিহাসিক দলিল ও শিল্পকর্ম সংরক্ষিত হয়।

কিন্তু এই সোনার জীবনেও ক্রমে ধরা দিতে থাকে এক শূন্যতা। তাঁর চারপাশে রাজত্বের চাকচিক্য থাকলেও বাস্তবতা বদলে যাচ্ছিল দ্রুত। ভারতের স্বাধীনতার পর রাজাদের ক্ষমতা কেটে দেওয়া হয়, প্রিভি পার্স বাতিল হয়, আর রাজপ্রাসাদের ব্যয়ভার ক্রমেই বেড়ে ওঠে অচল বোঝায়।

তবু মুকাররম জাহের রাজকীয় জীবন ছিল এমন এক দৃষ্টান্ত, যা ইতিহাসে একরকম রূপকথার মতো স্থান পেয়েছে। তিনি যেন এক রাজপুত্র, যিনি সোনার খাঁচায় বাস করতেন—বাইরে ঝলমল করত ঐশ্বর্য, কিন্তু ভিতরে শুরু হচ্ছিল নিঃসঙ্গতার এক ধীর বিষাদ।

এই পর্ব শেষ হয় রাজকীয় জৌলুশের চূড়ান্ত মুহূর্তে, যেখানে হায়দরাবাদ রাজপ্রাসাদের ঝলকানি এখনও চোখে ভাসে। কিন্তু সেই সোনালি আলো শিগগিরই ম্লান হতে চলেছে—কারণ সামনে অপেক্ষা করছে পতনের প্রহর।

(পরবর্তী পর্ব: “রাজ্যের পতন ও নিঃসঙ্গতার শুরু — যখন হায়দরাবাদ হারায় নিজের মুকুট”)