প্রেম যদি হয় হৃদয়ের ধর্ম, তবে লাইলি-মজনুনের কাহিনী সেই ধর্মের অমোঘ শাস্ত্র। হাজার বছর ধরে এই উপাখ্যান নানা ভাষায়, নানা সংস্কৃতিতে বিস্তার লাভ করেছে। যেমন রোমিও-জুলিয়েট ইউরোপের, তেমনি লাইলি ও মজনুন আরব বিশ্ব তথা মুসলিম সাহিত্যের প্রেম-দরবেশ। তাদের কাহিনী সময়কে অতিক্রম করে দাঁড়িয়ে আছে ভালোবাসার সবচেয়ে বেদনাবিধুর ও পবিত্র রূপ হিসেবে।
কায়েস ইবনে আল-মুলাওয়াহ ছিলেন উমাইয়া যুগের আরব বেদুইন কবি। একটি মরুপ্রান্তরের গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রেমকাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু লাইলি বিনতে মহদি, যিনি ছিলেন একই গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত ও গুণবতী কন্যা। কিশোর বয়সে যখন তাঁরা এক মক্তবে পড়াশোনা করতেন, তখনই তাঁদের হৃদয়ে জন্ম নেয় এক অনাবিল টান। নিঃশব্দ সেই আকর্ষণ দিনে দিনে রূপ নেয় গভীর প্রেমে।
তাঁদের মাঝে তখনো কোনো কথা হয়নি, হয়নি চোখে চোখ রাখা। কিন্তু সেই লুকানো অনুভবই ছিল এত গভীর, যা ভাষার ঊর্ধ্বে। কায়েসের হৃদয়ে লাইলির জন্য এক অপার আসন তৈরি হয়, এবং কিশোর প্রেম পরিণত হয় জীবনমরণ প্রশ্নে।
তাদের প্রেম সমাজকে মেনে নিতে পারেনি। একদিকে ছিল পারিবারিক গোঁড়ামি, অন্যদিকে মরু সংস্কৃতির রূঢ় বাস্তবতা— যেখানে কন্যা সন্তানদের স্বাধীন প্রেম ছিল সামাজিক লজ্জা ও অসম্মানের বিষয়।
কায়েসের প্রেমে বিভোরতা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে তিনি লাইলির নাম জপতে থাকেন সবার সামনে, কবিতায় তার নাম উচ্চারণ করতে থাকেন সর্বত্র। এতে লাইলির পরিবারের সম্মান হানির ভয় দেখা দেয়। তাঁরা লাইলিকে কায়েস থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
লাইলিকে হারিয়ে কায়েস হয়ে ওঠেন “মজনুন”— যার অর্থ পাগল। তিনি সব রকম সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করে বনে চলে যান। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তিনি মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত, বন্য জীবজন্তুর মাঝে ঘুরে বেড়ান। তিনি নিজের দেহকে কষ্ট দিয়ে, কাঁটা ঝোপের নিচে শুয়ে, পশুদের সঙ্গে বসবাস করে ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে থাকেন।
প্রকৃতি, পশু, পাখি ও বাতাসই হয়ে ওঠে তাঁর সাথী। তিনি তাঁর প্রেমকে দেহের নয়— আত্মার স্তরে পৌঁছে দেন। লাইলির স্মৃতি ও নাম তাঁর একমাত্র সাধনা। কবিতায়, বেদনায়, নিঃসঙ্গ প্রার্থনায় তিনি এক প্রেম-সাধক।
তিনদিকে যখন কায়েসের পাগলামি ছড়িয়ে পড়ে, তখন লাইলির পরিবার তাঁর বিয়ে আরেকজন সম্ভ্রান্ত যুবকের সঙ্গে দেন। যদিও কায়েসের প্রেম তাকে ত্যাগ করেনি, তথাপি সমাজের চাপে সে অন্যের ঘরনী হয়ে যায়।
বিয়ের পরও লাইলি ছিলেন একা, নিঃসঙ্গ, নিরব কান্নায় দগ্ধ। স্বামী তাঁর হৃদয় জিততে পারেননি। লাইলি হৃদয়ে শুধু মজনুনকে ধারণ করতেন— এক অন্তর্লীন প্রেম, যা জীবনের সঙ্গে নয়, আত্মার সঙ্গে জড়িত।
শেষপর্যন্ত, লাইলি মৃত্যুবরণ করেন দীর্ঘ অন্তর্দহে। মজনুন যখন এ সংবাদ পান, তিনি তাঁর সব শক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিছু কাহিনীতে বলা হয়, তিনি লাইলির কবরের পাশে বসেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, লাইলি ও মজনুনের কবর পাশাপাশি— দুটি হৃদয়ের এক শান্তি। জীবনে মিল না হলেও, মৃত্যুর পর তাঁরা চিরজীবনের মিলনে পৌঁছান।
এই প্রেমগাথা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উপমহাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। পারস্যে নিযামী গঞ্জাভী তাঁর মহাকাব্য “মজনুন ও লাইলি” রচনা করেন, যা পরে উর্দু, বাংলা, তুর্কি, ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়।
এই কাহিনীর সারকথা হলো— প্রেম শুধুমাত্র দেহগত বা বৈবাহিক নয়, এটি আত্মিক এক সাধনা। সেই প্রেম বাস্তবে পরিণতি না পেলেও তা বিশুদ্ধ হতে পারে, অমর হতে পারে।
লাইলি-মজনুনের কাহিনী প্রমাণ করে, ভালোবাসা শুধু মিলনের গল্প নয়— বিচ্ছেদের মধ্যেও প্রেম পূর্ণতা পায়। ভালোবাসা যখন সমাজ, ধর্ম, নিয়মকানুনের উর্ধ্বে উঠে যায়, তখনই তা হয়ে ওঠে চিরন্তন। লাইলি ও মজনুন আমাদের শেখান, প্রেম কখনো সময় বা অবস্থার সীমানায় বাঁধা পড়ে না— বরং তা আত্মার মুক্তি, হৃদয়ের সাধনা।
সংগৃহীত