Home বিনোদন লালন স্মরণোৎসব: মিলনমেলা না পর্যটন উৎসব

লালন স্মরণোৎসব: মিলনমেলা না পর্যটন উৎসব

ছবি : এআই

লালনের দেশে: পর্ব ৬

মোজাফফর রাহমান বাদল, কুষ্টিয়া: ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে প্রতিবছর যে স্মরণোৎসব হয়, তা যেন শুধু একটি সংগীতানুষ্ঠান নয়, হয়ে ওঠে এক আধ্যাত্মিক মিলনক্ষেত্র। ফকির লালনের মৃত্যুবার্ষিকীতে হাজারো অনুসারী, দর্শক, গবেষক ও কৌতূহলী মানুষ ছুটে আসেন কুষ্টিয়ার এই নির্জন প্রান্তে। কেউ আসেন গানের টানে, কেউ দর্শনের আকর্ষণে, আবার কেউ নিছক উৎসবের আমেজ নিতে।

এই উৎসব মূলত তিনদিন ব্যাপী হলেও আখড়ায় প্রস্তুতি শুরু হয় তারও অনেক আগে থেকে। বাউলরা দূরদূরান্ত থেকে এসে জড়ো হন, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বসেন তক্তপোশে। শুরু হয় গান সাধনা, চলে গভীর রাত পর্যন্ত। চারদিকে শোনা যায় একতারা, ডুগি, খমক আর মনছোঁয়া কণ্ঠের যুগলবন্দি। দর্শনার্থীরা ঘুরে বেড়ান আখড়ার চারপাশে, কেউ গানে মগ্ন, কেউবা চুপচাপ বসে আছেন সমাধির পাশে।

তবে এই উৎসব আজ আর কেবল বাউলদের ভক্তিমূলক মিলনমেলা নয়। সময়ের প্রবাহে এতে ঢুকে পড়েছে নানা রকম বাণিজ্যিকতা ও বহিরাগত প্রভাব। আখড়ার আশেপাশে বসে দোকানপাট, বিক্রি হয় নানা সামগ্রী। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এই উৎসবকে ঘিরে প্রচার চালায়, মিডিয়া প্রচার পায় নতুন চমক। ফলে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, এ কি তবে শুধুই এক পর্যটন উৎসবে পরিণত হচ্ছে?

লালনের অনুসারীরা দ্বিধায় ভোগেন। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, বেশি মানুষের আগমন মানেই লালনের বাণী ছড়িয়ে পড়া, কিন্তু কেউ কেউ বলেন, এত ভিড়, এত কোলাহল আসলে লালনের নিঃশব্দ সাধনার পরিপন্থী। কারণ এ উৎসব একসময় ছিল অন্তর্জগতের খোঁজ, এখন তা অনেকাংশে বাহ্যিক আনন্দে পরিণত হয়েছে।

তবুও এই স্মরণোৎসব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। এখানে নতুন প্রজন্মের অনেকেই প্রথমবারের মতো লালনের গান শোনেন, অনেকেই নতুন করে জানতে চান তার দর্শন। দেশের নানা প্রান্তের গবেষক, শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকরা এখানে এসে ভাব বিনিময় করেন, গান শোনেন, বক্তৃতা দেন। এমনকি বিদেশি দর্শনার্থীরাও মুগ্ধ হন এই আয়োজনে, যদিও তাদের অনেকের কাছে তা নিছক এক ধরনের লোকজ মেলা।

আখড়াবাড়ির ভেতরে এখনও যে নিরব সাধনার ধারা আছে, সেই ধারাকে রক্ষা করতে প্রয়োজন উৎসবের মধ্যেও একটি আধ্যাত্মিক ভারসাম্য। যেন ব্যবসা, প্রচার আর দর্শনের মধ্যে একটিকে অপরটির ওপরে না তোলা হয়। লালনের জীবন ছিল নিরব, নিরাভরণ, তার স্মরণেও প্রয়োজন সেই নির্জনতার সম্মান।

যদি স্মরণোৎসব হয় উপলক্ষ, তবে তার অর্থ হওয়া উচিত আত্মসন্ধানের ডাক, মানবতার গান আর ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে ওঠার এক চিরন্তন প্রয়াস।

উৎসবের পরও আখড়াবাড়ির ছায়ায় চলতে থাকে সাধনা ও শিক্ষা। পরবর্তী পর্বে জানুন লালন একাডেমি: কী শেখায়, কে শেখে, শুধুমাত্র বিজনেসটুডে২৪.কম–এ।