Home পরিবেশ সাদাপাথর লুটপাট: প্রকৃতির ক্ষত সারিয়ে সুশাসনের পথে

সাদাপাথর লুটপাট: প্রকৃতির ক্ষত সারিয়ে সুশাসনের পথে

তারিক-উল-ইসলাম, ভোলাগঞ্জ ( সিলেট): সিলেটের ‘বাংলার কাশ্মীর’ খ্যাত ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকাটি ২০২৫ সালের মধ্যভাগে এসে এক অরাজক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে আগস্টের শুরুতে একটি বিশাল চক্র শত শত কোটি টাকার পাথর লুট করে নিয়ে যায়। তবে পরবর্তী কয়েক মাসে যৌথ বাহিনীর অভিযান এবং নতুন প্রশাসনের সাহসী ভূমিকা সেই হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

আগস্টের শুরু থেকে অন্তত ৪ থেকে ৫ হাজার শ্রমিক ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দিনের আলোতে ট্রাক ও নৌকায় করে কয়েক লাখ ঘনফুট সাদা পাথর লুট করে। পর্যটন কেন্দ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরগুলো গায়েব হয়ে যাওয়ায় এলাকাটি ধূ ধূ বালুচরে পরিণত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ধ্বংসযজ্ঞের ছবি ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং উচ্চ আদালত এই পাথর উদ্ধারের নির্দেশ দেন।

লুটপাটের ঘটনায় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (BMD) এবং স্থানীয় প্রশাসন কয়েক হাজার অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করে।

আসামি ও গ্রেফতার: লুটপাটের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রায় ২ হাজার জনকে আসামি করে বড় আকারের মামলা চলমান রয়েছে।

দুদকের তদন্ত: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে জানতে পারে যে, এই লুটপাটে ৫ শতাধিক রাজনীতিবিদ, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ ছিল। অভিযুক্তদের স্থাবর সম্পদের খোঁজ নিতেও শুরু করেছে দুদক।

সিলেট জেলা প্রশাসন ও যৌথ বাহিনীর (সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি) এক মাসব্যাপী চিরুনি অভিযানে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

জব্দ ও প্রতিস্থাপন: বিভিন্ন ক্রাশার মিল এবং গোপন আস্তানা থেকে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে।

সাদাপাথরে প্রত্যাবর্তন: উদ্ধারকৃত পাথরগুলো ট্রাক ও নৌকায় করে পুনরায় ভোলাগঞ্জের মূল পয়েন্টে নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, প্রতিটি উদ্ধারকৃত পাথর আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে পর্যটন কেন্দ্রটি তার প্রাকৃতিক রূপ ফিরে পায়।

আগস্টের শেষের দিকে সিলেটের নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে মো. সারোয়ার আলম দায়িত্ব নেওয়ার পর সাদাপাথর রক্ষায় জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেন। তার কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলো:

চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি: তিনি দায়িত্ব নিয়েই অবৈধ পাথর দখলকারীদের জন্য ‘ডেডলাইন’ বা সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন। তার কড়া বার্তার পর অনেক পাথর ব্যবসায়ী নিজ উদ্যোগে লুট করা পাথর ফেরত দিতে শুরু করেন।

সিসিটিভি ও সার্বক্ষণিক নজরদারি: পুরো সাদাপাথর এলাকাকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে এবং সেখানে ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি আনসার ও বিশেষ প্রহরী নিয়োগ করা হয়েছে।

ক্রাশার মিল সিলগালা: অবৈধভাবে পাথর মজুত রাখা কয়েকশ ক্রাশার মিল বন্ধ ও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা জারি: জেলাজুড়ে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন, পরিবহন ও বিক্রির ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর মতে, সাদাপাথরের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। তবে বর্তমান জেলা প্রশাসকের কঠোর অবস্থানের কারণে নতুন করে পাথর লুটের সাহস কেউ দেখাচ্ছে না। যদি এই তদারকি ২০২৬ সালেও বজায় থাকে, তবে সিলেটের পর্যটন তার প্রাণ ফিরে পাবে।

২০২৫ সালটি সিলেটের মানুষের জন্য ছিল প্রতিবাদের বছর। একদিকে লুটপাটের গ্লানি, অন্যদিকে প্রশাসনিক কঠোরতায় সেই সম্পদ পুনরুদ্ধারের সাফল্য। ২০২৬ সালের শুরুতে পর্যটকরা আবার সেই পুরনো সাদাপাথরের রূপ দেখতে পাবেন—এমনটাই প্রত্যাশা সিলেটের সচেতন মহলের।

এ ধরণের আরও গুরুত্বপূর্ণ আপডেট পেতে ভিজিট করুন www.businesstoday24.com