বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়েছে একটি ভয়াবহ আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্র। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুই চীনা নাগরিক ও তাদের স্থানীয় সহযোগীকে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন চীনের হু জানজুন (৩০), জিয়াং লিজি (৫৪) এবং বাংলাদেশের গাইবান্ধার বাসিন্দা মো. নয়ন আলী (৩০)।
এই ঘটনায় সামনে এসেছে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। মাত্র ১৯ বছর বয়সী এক তরুণীকে প্রেম, বিয়ের প্রতিশ্রুতি ও বিদেশে স্বচ্ছল জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে চীনে পাচারের পরিকল্পনা করেছিল এই চক্রটি।
ঘটনার সূত্রপাত সোমবার রাতে। বিমানবন্দরের প্রধান ফটকের কাছে সাহসিকতার সঙ্গে উপস্থিত হয়ে ওই তরুণী অভিযোগ করেন যে, তাকে জোর করে চীনে পাচার করা হচ্ছে। তার এই সাহসী পদক্ষেপের পরই তৎপর হয় এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। সহকারী পুলিশ সুপার ফাউজুল কবীর মঈনের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে দুই চীনা নাগরিককে বিমানবন্দরের ভেতর থেকে আটক করা হয়।
পরবর্তীতে ভুক্তভোগীর বর্ণনার ভিত্তিতে রাতেই অভিযান চালানো হয় ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় পাচারচক্রের আরেক সদস্য নয়ন আলীকে। অভিযানকালে উদ্ধার হয় ভুয়া কাগজপত্র, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, প্লেনের টিকিটসহ পাচারের প্রমাণস্বরূপ গুরুত্বপূর্ণ আলামত।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ধৃত দুই চীনা নাগরিক প্রায় এক বছর আগে বাংলাদেশে আসে এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া নেয়। তারা নয়ন আলীর মাধ্যমে দরিদ্র তরুণীদের খুঁজে বের করত এবং প্রেম ও বিয়ের ফাঁদে ফেলে বিদেশে পাচারের প্রস্তুতি নিত। ভুক্তভোগী তরুণীর ক্ষেত্রেও একই কৌশল প্রয়োগ করা হয়। চীনা নাগরিক হু জানজুনের সঙ্গে বিয়ের নাটক সাজিয়ে তরুণীকে তার নামেই পাসপোর্ট ও টিকিট তৈরি করে চীনে পাঠানোর পরিকল্পনা নেয় চক্রটি।
তবে শেষ মুহূর্তে তরুণীর সাহসিকতা ও পুলিশি তৎপরতায় সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বুধবার ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় মানবপাচার আইনে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের একাধিক ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, পলাতক আরও কয়েকজন সদস্যকে ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে এপিবিএনের পুলিশ সুপার (অপারেশন্স) মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, “এটি চলতি মাসে দ্বিতীয়বার, যখন চীনা নাগরিকদের সংশ্লিষ্ট একটি চক্র ধরা পড়ল। এই ধরনের চক্র দরিদ্র পরিবারের সহজ-সরল মেয়েদের টার্গেট করে। বিয়ের প্রলোভনে তাদের বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানকার অবৈধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়।”
এপিবিএনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নারী পাচার প্রতিরোধে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। তরুণীদের রক্ষায় পরিবারকে সচেতন হতে হবে এবং কোনো সন্দেহজনক ঘটনা হলে তা সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে।
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হলো, আন্তর্জাতিক পাচারচক্র এখন আরও সুসংগঠিত ও কৌশলী হয়ে উঠছে। তবে পুলিশের তৎপরতায় তাদের নেটওয়ার্ক ভাঙছে, এবং আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে।
এই ঘটনাটি কেবল বিচ্ছিন্ন নয়। বাংলাদেশে নারী পাচার একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। সম্প্রতি খাগড়াছড়িতেও এক চীনা নাগরিক ও তার সহযোগীকে পাচারের সময় পাঁচ কিশোরীকে আটকে রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় পাচারকারী চক্রের আন্তর্জাতিক সংযোগ ও বাংলাদেশে তাদের সংগঠিত নেটওয়ার্ক আবার সামনে আসে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব চক্র সাধারণত দরিদ্র, প্রত্যন্ত এলাকার তরুণীদের টার্গেট করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে টিকটকের মতো অ্যাপে মডেলিং ও প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিদেশে পাচার করা হয়। ২০২১ সালে এ ধরনের একটি চক্র ভারতে শতাধিক তরুণী পাচার করেছিল বলে পুলিশ জানিয়েছিল।
চীনে নারীর অনুপাতে পুরুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাইরের দেশ থেকে ‘বিয়ের জন্য নারী’ সংগ্রহের নামে মানব পাচার বেড়েছে। পাচার হওয়া অনেক বাংলাদেশি নারী চীনে যৌন নির্যাতন ও দাসত্বের শিকার হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হওয়া অন্তত ২ হাজার নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে ফিরে আসতে না পারা অসংখ্য ভুক্তভোগীর খবর অধরাই থেকে যায়।
আপনার চারপাশে এমন সন্দেহজনক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে দ্বিধা করবেন না। সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনার একটি পদক্ষেপ হয়তো বাঁচাতে পারে একটি জীবন। এই প্রতিবেদনটি শেয়ার করে সচেতনতা বাড়ান।